নকশবন্দী তরিকা প্রজ্ঞা ও প্রেমের তরিকা। বিশেষ ওকুফে ক্বলবী বা আল্লাহর সাথে আত্ম মানসিক গভীর সংযোগ এর মূলনীতি। আল্লাহর উপস্থিতিতে নিজেকে জীবনভর হাজির রাখা এর চাবিকাঠি। বলা হয়, মস্তিষ্ক ভাববে, মন যুক্ত থাকবে, হাত কাজ করবে আর হৃদয়প্রাণ আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন থাকবে। লোকটি হোক শ্রমিক, বিজ্ঞানী, শাসক, সেনাপতি, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী কি দরবেশ।
পারস্যের কবি হাফিজ ছিলেন শীরাজ নগরের লোক। ভাবুক মানুষ। অনেক কবিতা আছে। কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান’ আছে। নাম ‘দিওয়ানে হাফিজ’। কবি কাজী নজরুল ইসলামও এর তরজমা করেছেন। তার এক কবিতা পৃথিবীতে তাকে অমরত্ব দিয়েছে। যেখানে কবি হাফিজ বলেন, ‘আগার আঁ তুর্কে শীরাজী বদস্ত আ রাদ দিলে মারা/ বখালে হিন্দওয়াশ বখশাম সমরকন্দ ও বোখারা রা।’ ইউরোপের একাধিক কবি এর ইংরেজি ফরাসি ও জার্মান তরজমা করেছেন। সফল হননি। আমাদের কবি নজরুল ছন্দে করেছিলেন, তার নিজেরই পছন্দ হয়নি। অনুবাদ সহজ নয়। তবে বাংলায় ভাবার্থ যা দাঁড়ায়, সেটি হলো, হাফিজ বলেন, ‘শীরাজ শহরে যে তুর্কি সুন্দরী আমার হৃদয় ছিনতাই করে চলে গিয়েছে, যদি সে তা ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়, তাহলে আমি তার গালের তিলের বিনিময়ে তাকে দুনিয়ার দুই শ্রেষ্ঠ নগরী বোখারা ও সমরকন্দ পর্যন্তও দিতে রাজি আছি।’
একজন পরিচ্ছন্ন সুফি কবির এ উপমা উৎপ্রেক্ষা ভরা নিটোল কবিতার দু’টি লাইন কোনো হিংসুকের মাধ্যমে গিয়ে পৌঁছুলো শাসক তৈমুর লংয়ের কাছে। সময়টি ছিল খুবই খারাপ। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে তিনি এ দু’টি শহর মাত্র জয় করেছিলেন। বলা হয়, সত্তর হাজার শত্রু সৈন্যের মাথার মুন্ডু দিয়ে বিশাল এক বিজয় মিনার তৈরি করা হয়েছিল। সৈন্যরা হাফিজে শীরাজিকে ধরে নিয়ে গেল তৈমুর লংয়ের রাজদরবারে। তিনি সরাসরি জানতে চাইলেন, কোথাকার কোন প্রিয়ার গালের তিলের বিনিময়ে আমার বহু সাধনার বিজিত দুই নগরী বোখারা ও সমরকন্দ তুমি দিয়ে দিচ্ছ?
পরিবেশ পরিস্থিতি বড়ই ভীতিকর ছিল। কবিতার অর্থ বিকৃত করে রাজদ্রোহী সাব্যস্ত করাও ছিল সহজ। এক কোপে গর্দান যেতে পারতো কবি হাফিজের। কিন্তু তিনি তার মেধা ও মনন, ভাবনা ও লালিত্যকে আসলেই যে কোনো সাম্রাজ্যের বেশি ভালোবাসতেন। আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিলেন, জাহাপনা আমি হৃদয়ঘটিত বিষয়াদি নিয়েই কাজ করি। আমার কাছে আত্মা ও ভাবনার মূল্য অনেক। ভালোবাসা পাওয়া, মানবতা, মনুষ্যত্ব, প্রীতি ও শুভ কামনা আমার কাছে রাজত্বের চেয়েও বেশি পছন্দের। আপনি আমাকে অপরাধ নেবেন না। আমি আসলেই বোখারা সমরকন্দ যাকে ভালোবাসি তাকে দিয়ে দিতে পারব। আর এমন বেহিসেবি বলেই তো আমি কবি। তৈমুর লং কবিকে বিদায় করে দিলেন। সেদিনের ঘটনা যাই হোক। ইতিহাস এ দু’টি লাইন বিশ্বসাহিত্যের আকাশে নক্ষত্র দিয়ে লিখে রেখেছে।
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাশখন্দ। সেখান থেকে বোখারা সমরকন্দ উলুঘবেগ আরোফা খাতুন মীরে আরব নাসা তিরমিজ গজদোয়ানি ইত্যাদি ১০ দিন ধরে ঘুরে দেখার সুবর্ণ সুযোগ নকশবন্দী ফেস্টিভাল ২০১৯। ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে ট্রানজিটসহ প্রায় ১৯ ঘণ্টার সফর। দুনিয়ার হাজারও লোকের ভিড়ে আমরা কী এত শত লাহুতের মুক্ত বিহঙ্গের ডানা ঝাপটানি কিছুটা হলেও টের পাবো? আধ্যাত্মিক সুরভীর কোনো রেশ লাভের ক্ষমতা কী আছে বহুবিধ দূষণকবলিত এসব নাসারন্ধ্রের? যাকে নিজের পিতা-পুত্র এমনকি পৃথিবীর সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি তার কিংবা তার কোনো ভক্ত প্রেমিকের মন পাওয়ার জন্য দিয়ে দেয়া যাবে কি বোখারা সমরকন্দ? যিনি আমাদের এ জীবন, এ চেতনা, এ বিশ্বাস, এ ভালোবাসা, এক কথায় ইহজগতের সব দিয়েছেন। তাকে কী দেয়া যায়? নিজে কিছু ভেবে না পেলে নিয়ম হচ্ছে, অন্যের সাহায্য নেয়া। সাহায্য পাবো তো?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন