মানব ভ্রাতৃত্বের কতিপয় অধিকার রয়েছে, যেগুলো পালন করা মানুষের একান্ত কর্তব্য। মুসলমান হিসেবে এগুলো ধর্মীয় কর্তব্যেরও অন্তর্ভুক্ত। অমুসলিম মানব সম্প্রদায়কে তবলীগ করার জন্য ইসলামের যে নির্দেশ, অন্যান্য কারণ ছাড়াও তার একটি কারণ এই : একজন মুসলমান যে জিনিসটি সত্য মনে করে সে সম্পর্কে অপর লোককে অবহিত করা তার মানবিক দায়িত্ব। মানব কল্যাণ ও সৌভ্রাতৃত্বের এটি একটি অপরিহার্য পরিণতি। এই প্রেরণা অনুভ‚তি নিয়েই মুসলমানেরা ইসলাম প্রচার সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই তারা দুনিয়াময় ইসলাম প্রচারে সক্ষম হয়েছিলেন। পবিত্র কোরআন তাওরাতের কোনো কোনো বিধিবিধানের পুনরাবৃত্তি করে ঘোষণা করেছে- ‘ক্বূলূ লিল্লাহে হুসনান।’ অর্থাৎ হে লোক সকল! তোমরা মানুষের সাথে উত্তম কথাবার্তা, বলো।’ (সূরা : বাকারা)।
অপর একটি আয়াতে বলা হয়েছে : ‘এবং কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা হেতু সুবিচারের অন্যথা করো না। তোমরা সুবিচার করো, এটাই ধর্মভীরুতার নিকটবর্তী এবং আল্লাকে ভয় করো, তোমরা যা করো নিশ্চয়ই আল্লাহ তদ্বিষয়ে অভিজ্ঞ।’ (সূরা মায়েদা)।
পবিত্র কোরআন ছাড়াও অসংখ্য হাদিস এমন আছে যা মহানবী হযরত রাসূলে করীম (সা.) মানবীয় অধিকারসমূহ পালন করার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘এই সওয়াব বা পুণ্যের সীমারেখা এতই প্রশস্ত-ব্যাপক যে, তাতে প্রত্যেক জীবনধারী বস্তু অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী অংশীদার।’
তিরমিজী শরীফে হযরত আবু জর (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা যেখানেই অবস্থান করনা কেন আল্লাহকে স্মরণ রাখবে, মন্দের পরিবর্তে ভালো করিবে এবং মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার করবে।’
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেছেন : ‘একদা হুজুর (সা.) পাঁচটি বস্তুর উল্লেখ করলেন। তার একটি ছিল এই যে, ‘তোমরা সকলে প্রত্যেক লোকের জন্য তাই কামনা। তোমরা পরস্পর হিংসাবিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর মুখ ফিরিও না, তোমরা সকলেই আল্লাহর বান্দা এবং পরস্পর তোমরা ভ্রাতৃত্ব স্বরূপ হয়ে যাও।’ (বোখারি)
মহানবী (সা.) আরো বলেছেন : ‘প্রত্যেক তরল বস্তুর সাথে সদাচরণ করাতে সওয়াব রয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টির প্রত্যেক বস্তু যার মধ্যে প্রাণের স্পন্দন রয়েছে, তার সাথে উত্তম ব্যবহারে পুণ্য অর্জন হয়।’ (বোখারি)।
মহানবী (সা.) বলেছেন : ‘তোমরা সেই সকল কাজ করো, যা তোমরা নিজেদের জন্য উত্তম মনে করো। তবেই তোমরা সত্যিকারের মুসলমান হতে পারবে।’ (তিরমিজী)।
এতে প্রমাণিত হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র মানবমন্ডলীর কল্যাণ সাধনের প্রেরণা অন্তরে সৃষ্টি হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো মানুষ সত্যিকারের মুসলমান হতে পারবে না এবং সে মহানবী (সা.)-এর দরবারেও নিজেকে মুসলমান বলে দাবি করার অধিকার রাখবে না।
ইমাম কাজী আবু ইউসুফ তাঁর ‘কেতাবুল খেরাজ’-এ লিখেছেন, একবার হযরত ওমর (রা.) দেখলেন যে, একজন অন্ধ বৃদ্ধ লোক তাঁর দরজায় এসে ভিক্ষা চাচ্ছে। হযরত ওমর (রা.) পেছনে এসে তার হাত ধরে ফেললেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার ভিক্ষা চাওয়া প্রয়োজন কেন?’ বৃদ্ধ অন্ধ লোকটি উত্তরে বলল, ‘করের বোঝা হতে মুক্তি সাধন, প্রয়োজন পূরণ করা এবং উপরন্তু বার্ধক্যজনিত কারণে আমি ভিক্ষাবৃত্তি আরম্ভ করেছি।’ উত্তর শ্রবণ করে হযরত ওমর (রা.) বৃদ্ধ অন্ধ ভিক্ষুককে নিজ গৃহে নিয়ে গেলেন এবং গৃহ হতে কিছু দান করে আবার তাকে বায়তুল মালের রক্ষকের নিকট প্রেরণ করলেন এবং নির্দেশ পাঠালেন যে, এই বৃদ্ধলোক ও তার মতো অন্যদের প্রতি যেন দৃষ্টি রাখা হয়। নির্দেশনামায় হযরত ওমর (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর শপথ, আমরা ইনসাফ করব না, যদি আমরা তার যৌবনের উপার্জন ভোগ করি এবং বৃদ্ধ বয়সে তার সাহায্য করা ভুলে যায়।’
পবিত্র কোরআনে দান-খয়রাত করার যে অনুমতি দান করা হয়েছে, তা ফকির-মিসকিনদের জন্য, যারা মুসলমান এবং যারা গ্রন্থধারী দরিদ্র-মিসকিন, তাদের উপর কর ধার্য না করার কথা বলা হয়েছে। এভাবে ইসলাম মুসলিম ও অমুসলিমের প্রশ্নের চিরতরে মীমাংসা করে দিয়েছে।
কিতাবুল আমওয়ালে উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত আবু ময়সরা আমর বিন মায়মুন এবং ওমর বিন শরাহবিল ফেতরার অর্থ দ্বারা খ্রিষ্টান পাদ্রীদের সাহায্য করতেন।
বোখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে যে, মহানবী (সা.)-এর জমানায় হযরত (সা.) তাঁর মোশরেক ভ্রাতাকে তোহফা (উপঢৌকন) দিতেন। স্বয়ং নবী করীম (সা.) কোনো কোনো লোককে তাদের মোশরেক মাতা-পিতার সাথে আত্মীয়সুলভ ব্যবহারের অনুমতি দান করেন। (মুসলিম)।
মুসনাদে আহমদে বর্ণিত হয়েছে যে, হুজুর (সা.) মুসলমানদের উদ্দেশে বলেছেন : ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত খাঁটি মোমেন হবে না, যতক্ষণ না সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে তা অপর মানুষের জন্যও পছন্দ করবে এবং যতক্ষণ না সে মানুষকে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসবে।’
ইসলামের এই ধর্মীয় ও মানবিক আদর্শ প্রচারের কথা কেবল মুখে উচ্চারণ করলেই কর্তব্য শেষ হয়ে যাবে না, আমাদের প্রত্যেকের বাস্তব জীবনেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন