শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

সুন্দরবন রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০১৯, ৫:২৭ এএম

গত সপ্তাহে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল যে রূপ ধারণ করেছিল, তা যদি পূর্ণশক্তি নিয়ে আঘাত করত, তাহলে বাংলাদেশের উপকূলের অবস্থা কী হতো, তা কল্পনাও করা যায় না। তবে তা কিছুটা আঁচ করা গেছে। দুর্বল হয়ে এটি যে আঘাত করেছে, তাতেই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি, বাড়িঘর ও ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে, তা উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের অনেক দিন সইতে হবে। বুলবুলের এই যে দুর্বল আঘাত, যদি সুন্দরবন না থাকত, তাহলে ঐসব অঞ্চল তাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যেত। পত্র-পত্রিকায়ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, মায়ের আঁচলের মতো আগলে রেখে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা করেছে। এই সুন্দরবন আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য প্রকৃতির এক অপার দান। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, এই বনটিকে রক্ষায় আমরা তেমন কিছুই করছি না। উল্টো এর পরিবেশ-প্রতিবেশ ধ্বংসে যত ধরনের অপকর্ম করা দরকার তার সবই করা হচ্ছে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝার যে একটা প্রবাদ আছে, তা বুঝতে পারছি না। সুন্দরবন আছে বলেই এখনও আমরা তার মর্যাদা উপলব্ধি করছি না। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হবে এবং এ থেকে উত্তরণ কত কঠিন হবে, তার আলামত এখন পাওয়া যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়ে লবণাক্ততার আগ্রাসন বাড়বে। সুপেয় পানির মারাত্মক সংকট দেখা দেবে এবং বিশাল এলাকায় জমির স্বাভাবিক উর্বরতা বিপন্ন হবে। সারাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাবে, কৃষিখাতে বিপর্যয়, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, ঘূর্ণিজড়, জলোচ্ছ্বাস অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাবে। লন্ডনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ম্যাপলক্রাফট কয়েক বছর আগে বিশ্বের ১৭০টি দেশের উপর জরিপ চালিয়ে যে ১৬টি দেশকে সর্বাপেক্ষা ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, চির ঝড়-ঝঞ্ঝার দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন নতুন এক প্রাকৃতিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ুর বিরূপ পরিবর্তনজনিত কারণে ৭১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গোপসাগরীয় তটরেখার কিনারজুড়ে প্রতিনিয়ত পানি ফুলে-ফেঁপে স্ফীত হচ্ছে। এর ফলে দেশের ১৯টি জেলা তথা মোট আয়তনের শতকরা ৩২ ভাগ এলাকা ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। এ এলাকার ৪ কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে। প্রতিনিয়ত ভূমির পরিবর্তন ঘটছে। উপকূল, চর, দীপাঞ্চলের ভূমি তলিয়ে বা হারিয়ে যাচ্ছে। বাস্তভিটা হারিয়ে উপকূলের মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। কাজের সন্ধানে লাখ লাখ মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া সামাজিক ভারসাম্য ও শৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

দুই.
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতই দিন যাচ্ছে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগের তুলনায় বেশিমাত্রায় ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এসব অঞ্চলের অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সাগর অশান্ত হয়ে উঠছে। সাগরে অবস্থিত বিভিন্ন চর ও দ্বীপাঞ্চলে ভাঙ্গনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে সাগরের করালগ্রাসে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ার ২৫০ বর্গ কিলোমিটার, ভোলা জেলার ২২৭ বর্গ কিলোমিটর এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের ১৮০ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে। পতেঙ্গা থেকে শুরু করে কক্সবাজার, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। এ অঞ্চলের জীববৈচিত্রে দেখা দিয়েছে অস্বাভাবিকতা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে লম্বালম্বি আকৃতির গুপ্তখালের সৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে চোরাবালির ঘূর্ণিফাঁদ সৃষ্টি হচ্ছে। ঘূর্ণিফাঁদে পড়ে ইতোমধ্যে অনেকেরই প্রাণহানি ঘটেছে। এছাড়া ভূমিধস ও ফাটল অব্যাহত রয়েছে। জলবায়ু ও ভূবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, ২১০০ সাল নাগদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে বাংলাদেশের অনেক ভূমি সাগরে তলিয়ে যাবে। সেন্টমার্টিনসহ প্রায় অর্ধশত দ্বীপ ও চরাঞ্চলসহ দেশের উপকূলভাগ ও বাসিন্দারা অস্তিত্ব ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এর প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া এখনই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। সেখানে আবাদি জমির পরিমান ও গড় উৎপাদন কমছে। মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে নতুন নতুন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় ফসল উৎপাদন কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যেভাবে বাড়ছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যন্ত উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলের কমপক্ষে ২ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। সেন্টার ফর গ্লোবাল চেঞ্জের এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে প্রতিবছর দেশে ২০ লাখ মানুষের জীবিকা ধ্বংস এবং আড়াই থেকে তিন লাখ লোক বাস্তুহারা হচ্ছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে। জলবায়ুর এই বিরূপ পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সরকার কতটা সচেতন তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দেয়ার পদক্ষেপ নেয়ার তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। জলবায়ু ও পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় প্রতিনিয়ত আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ ও করণীয় সম্পর্কে বলে গেলেও এ নিয়ে উদ্যোগী ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যতক্ষণ না পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বাইরে না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন টনক নড়বে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল শতাব্দীর সবচেয়ে প্রলয়ংকারি ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসযজ্ঞের পর কিভাবে প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় থেকে মানুষের জানমাল রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কমিটি গঠিত হয়েছিল। এ কমিটির প্রধান ছিলেন তৎকালীন সচিব এম মোকাম্মেল। এটি মোকাম্মেল কমিটি হিসেবে পরিচিত ছিল। এ কমিটি দুর্যোগ প্রবণ সমুদ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উপযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলার সুপারিশ করেছিল। এতে বেড়িবাঁধ নির্মাণ, বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন, সহজ ও বোধগম্য আবহাওয়া সতর্ক সংকেত প্রচলন, দুর্যোগ সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধি, উপকূলভাগে এনজিও কার্যক্রমে সুষ্ঠু সমন্বয়, দুর্যোগকালীন খাদ্যশস্য ও গবাদিপশু রক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কিত খাতওয়ারি সমস্যা চিহ্নিত করে টেকসই উন্নয়নের দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এসব নির্দেশনা বাস্তবায়ন খুব একটা হচ্ছে না। অথচ তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সুপারিশ দ্রুত বাস্তবায়ন হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অনেকটাই সমাল দেয়া যেত। আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে সম্ভব হতো। বাস্তবতা হচ্ছে, জলবায়ুর বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হয়ে উপকূলভাগ ও এর বাসিন্দারা ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে ক্রমাগত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নিচ্ছে। মানুষের এই ঢল থামাতে হলে উপকূলীয় অঞ্চলকে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ থেকে রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তা নাহলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে সাথে এসব মানুষের জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়বে।

তিন.
দেশের সমগ্র উপকূল, চর, দ্বীপাঞ্চল প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিলীন হওয়ার মুখে পড়ার পাশাপাশি বিশ্বে প্রকৃতির সপ্তাশ্চর্য তালিকায় স্থান পাওয়া সুন্দরবনের অস্তিত্বও এখন বিপন্ন হওয়ার পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকা-ের শিকার হয়ে বিশ্বের বৃহৎ এই ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংসের মুখোমুখি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আগামী এক দশকের মধ্যে সুন্দরবনের বেশিরভাগ অংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। জলবায়ুর পরিবর্তন এবং একে ঘিরে ক্ষতিকর কর্মকা- এই ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে আইন উপেক্ষা করে এ বনের দশ কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে উঠেছে দুই শতাধিক শিল্পকারখানা। পরিবেশবিদরা বলছেন, যেভাবে শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে তা সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর। এ ক্ষতি হঠাৎ করে দেখা যাবে না। এক সময় এর প্রভাব বোঝা যাবে। এ নিয়ে পরিবেশবিদ ও বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করলেও সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তেমন কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। উল্টো সুন্দরবেনর পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্রের ক্ষতি হয়, এমনসব প্রকল্প যেমন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জাহাজভাঙ্গা কারখানা, ইটভাটাসহ নানা ধরনের স্থাপনা নির্মাণের অনুমতি দিয়ে সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এমন কর্মকা- দেখে পরিবেশবিদরা মনে করছে, সুন্দরবনের মর্ম কি, তা তারা উপলব্ধি করতে পারছে না। এই উপেক্ষা ও উদাসীনতা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মাথার উপর ছাদ ধসে পড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হুশ হবে না। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বনের ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে বাকি ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ভারতে। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক বিস্ময় হয়ে রয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করেছে। এর গুরুত্ব কতখানি তা বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা উপলব্ধি করলেও আমাদের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে চলেছে। বিশ্বের পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের কাছে এটি একটি অন্যতম প্রাকৃতিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত। এর কোন ক্ষয়ক্ষতি হলে তাদের উদ্বেগের শেষ থাকে না। তারা স্বচক্ষে দেখতে চলে আসে। গবেষণা করে, প্রতিবেদন দেয়। কয়েক বছর আগে ৩ লাখ ৫৮ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে শেলা নদীতে তেলের জাহাজ ডুবে যাওয়অর পর, এর কি ক্ষতি হতে পারে, তা দেখার জন্য জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি পরিবেশ বিজ্ঞানীরা সেখানে ছুটে গিয়েছিল। সরকার ক্ষতি হবে না বলে বারবার বললেও জাতিসংঘসহ পরিবেশবিদরা প্রতিবেদনে বলেছে, সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্রের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করার পরামর্শ দিলেও, তাতে সরকার কর্ণপাত করেনি। অর্থাৎ প্রকৃতির অপার ও অমূল্য এই দান রক্ষায় সরকারের এক ধরনের শৈথিল্য রয়েছে। সুন্দরবনকে যেন অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছে। প্রকৃতি দিয়েছে প্রকৃতিই একে রক্ষা করবে, এমন একটা ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই প্রকৃতিই যে পরিবর্তন হয়ে সুন্দরবনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করতে পারছে না। ২০০৭ সালে ইউনেস্কো বলেছে, প্রতি বছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪৫ সেন্টিমিটার করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ হারে বৃদ্ধি পেলে এ শতাব্দীর শেষ দিকে সুন্দরবনের শতকরা ৭৫ ভাগ ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয়ে যাবে। শুধু প্রকৃতির এই পরিবর্তনের প্রভাবে নয়, মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকা-ও সুন্দরবনকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটে সমুদ্র তীরবর্তী এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা চিংড়ি হ্যাচারিগুলো সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীববৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে। পরিবেশ দূষণকারী প্রকল্প স্থাপনও সুন্দরবনের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে উঠেছে। সুন্দরবন যদি না থাকে তাহলে কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে তার কিছু নমুনা উল্লেখ করা প্রয়োজন। দেশের একমাত্র বৃহৎ বনজসম্পদের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। সংরক্ষিত বনের শতকরা ৫১ ভাগ হারিয়ে যাবে এবং বনজসম্পদ থেকে আয়ের শতকরা ৪১ ভাগ কমে যাবে। দেশের ৪৫ ভাগ কাঠ ও জ্বালানি উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। মৎস উৎপাদন বন্ধ হয়ে লাখ লাখ মানুষ বেকার হয়ে পড়বে। অর্থনৈতিক এ ক্ষতির পাশাপাশি কল্পনাতীত প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। ২০০৭ সালে যে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত এনেছিল, ইউনেস্কোর প্রতিবেদন অনুযায়ী তাতে সুন্দরবনের শতকরা ৪০ ভাগ ক্ষতি হয়েছিল। সুন্দরবন যদি না থাকত তবে এর উপর সিডর যে আঘাত হেনেছিল, তা এসে পড়ত লোকালয়ে। এ ধ্বংসযজ্ঞ কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠত, তা কল্পনাও করা যায় না। সুন্দরবনের মতো প্রাকৃতিক প্রাচীর থাকার কারণে একদিকে ঘূর্ণিঝড় যেমন পুরোপুরি আঘাত হানতে পারছে না, তেমনি বিশাল উপকূলীয় এলাকা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, অমূল্য সম্পদ সুন্দরবন মনুষ্যসৃষ্ট কর্মকা- এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হতে চলেছে। এটি রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

চার.
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে সুন্দরবনসহ সমগ্র উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চল যেভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে, প্রতিরোধে এখন থেকে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে যে ক্ষতি হবে, তা কোনভাবেই পোষানো যাবে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে এখন পর্যন্ত যা টিকে আছে, যে কোন উপায়ে তা রক্ষা করতে হবে। দেশি-বিদেশি পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে সুন্দরবন রক্ষা এবং উপকূলভাগ রক্ষা প্রকল্প নামে আলাদা প্রকল্প গঠন করে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের মতো সুন্দরবন রক্ষায় প্রকল্প হাতে নেয়া জরুরি। মনে রাখা দরকার, সুন্দরবন প্রকৃতির অপার দান। এটা মানুষ সৃষ্টি করেনি। মানুষের পক্ষে তা করাও সম্ভব নয়। এটি যদি ধ্বংস হয়ে যায়, আরেকটি সুন্দরবন এ পৃথিবীতে তৈরি হবে না। কাজেই প্রকৃতির অমূল্য এই সম্পদ রক্ষায় সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে। সাম্প্রতিক বুলবুলের আঘাতে এর বৃক্ষরাজির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। তার ওপর এর ভেতরে গাছপালা বেসুমারভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে। এর ফলে এর ভেতরের অনেক জায়গা ফাঁকা হয়ে গেছে। দেখা যাচ্ছে, সুন্দরবনকে যথেচ্ছভাবে যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর ক্ষতির দিকটি বিবেচনা করা হচ্ছে না। আবার বিশ্ব জলবায়ু তহবিল থেকে যে অর্থ পাওয়া যায়, তার যথাযথ সদ্ব্যবহারও হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমরা মনে করি, জলবায়ু তহবিলের অর্থ যদি যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়, তবে সুন্দরবনসহ পুরো উপকূল রক্ষায় বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ অর্থ দিয়ে সবুজ বনায়নসহ দুর্যোগ প্রবণ উপকূল, চর ও দ্বীপাঞ্চলবাসীর জানমাল সুরক্ষায় কার্যকর অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়। শুধু উদ্যোগের প্রয়োজন। পাশাপাশি গণসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রচারণামূলক কার্যক্রম শুরু করতে হবে। ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ভূমিক্ষয় ঠেকাতে উপকূল, দ্বীপ ও চরাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপন কর্মসূচি গ্রহণ এবং প্যারাবন বা সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে।
darpan.journalist@gmail.com

 

 

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন