মহানবী (সা.) বংশ মর্যাদার দিক দিয়ে অর্থাৎ পৈতৃক দিকে যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ, মাতৃকুলের দিক থেকেও ছিলেন সর্বোত্তম। তিনি নিজেও বংশমর্যাদার গর্ব করেছেন। সহি বোখারীর বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁকে ‘বনি আদমের উত্তম শ্রেণীর মধ্যে প্রেরণ করা হয়েছে।’ মুসলিম শরীফের হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা হজরত ইসমাইল (আ.)-এর আওলাদের মধ্যে কেনানকে মর্যাদাবান করেছেন এবং কেনানার মধ্যে কোরেশকে এবং কোরেশের মধ্যে বনি হাশেমকে এবং বিন হাশেমের মধ্যে আমাকে মর্যাদাবান করেছেন।’
তিরমিজি শরীফে ‘উত্তম সনদ’-এ বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির মধ্যে আমাকে সর্বোত্তম দলে বানিয়েছেন।’ অতঃপর গোত্রগুলো নির্বাচিত করেন, তখন আমাকে সর্বোত্তম গোত্রে প্রেরণ করেন। ফের পরিবারগুলো মনোনীত করেন এবং আমাকে সর্বোত্তম পরিবারে পাঠান। সুতরাং, আমি আত্মা, জাতিসত্তা ও মূলের দিক থেকে তাদের সকলের চেয়ে উত্তম।
মহানবী (সা.)-এর বংশমর্যাদার শ্রেষ্ঠত্ব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। খোদ আল্লাহ তায়ালাই তা ঘোষণা করেছেন। পিতৃকুল থেকে তিনি সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, মাতৃকুল থেকেও তিনি অনুরূপ। বংশবিশারদগণ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পিতৃকুল ও মাতৃকুলের বিশদ বিবরণ দান করেছেন, যার দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। এমনকি তাঁর মাতার মাতা এবং তাঁর মাতার পরিচয় পর্যন্ত তুলে ধরেছেন, যাদেরকে বলা হয়েছে উম্মাহাতুন নবী- নবীর জননীকুল।
বিস্ময়ের বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মহীয়সী মাতার মাতা (নানী) এবং তাঁর মাতা এবং তাঁর মাতা এ তিনজনের একই নাম ছিল। তিন যুগের এ তিন রমণীর এই নাম হওয়ার দৃষ্টান্ত ব্যতিক্রমই বটে। আরবের বংশ বিশেষজ্ঞগণ সে বিবরণও প্রদান করেছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা কামাল উদ্দীন দামিরী (রহ.)-এর বর্ণনাটি নিম্নে তুলে ধরা হলো :
আবদুল বাকী ইবনে কা’নে তার ‘মোজাম’ গ্রন্থে এবং হাফেজ আবু তাহেব আহমদ ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আহমদ সালাফি হজরত সিয়ানা (রা.) হতে এই হাদিসটি বর্ণনা করেছেন; রাসূলুল্লাহ (সা.) হুনায়নের দিন বলেছেন, আমি সুলায়মের গোত্রের ‘আওয়াতেক’-এর পুত্র।
‘আওয়াতেক’ বলতে সুলায়ম গোত্রের তিন নারীকে বুঝানো হয়েছে, যারা রসূলুল্লাহ (সা.)-এর উম্মেহাতের (জননীকুলের) অন্তর্ভুক্ত। তাদের মধ্যে একজন আতেকা বিনতে হেলাল ইবনে ফালেজ ইবনে জাকওয়ান। তিনি ছিলেন আবদে মানাফ ইবনে কোসাইয়ের মাতা। দ্বিতীয়, আতেকা বিনতে মুররা ইবনে হেলাল ইবনে ফালেজ সালমিয়া। ইনি ছিলেন হাশেম ইবনে আবদে মানাফের মাতা। তৃতীয়জনের নাম আতেকা বিনতে আওকাম ইবনে মুররা ইবনে হেলাল সালমিয়া। তিনি হুজুর (সা.)-এর মহীয়সী মাতা হজরত আমেনার পিতা ওহাবের মাতা।
এ তিনজনের মধ্যে প্রথম হচ্ছেন দ্বিতীয়জনের ফুফু এবং দ্বিতীয় জন হচ্ছেন তৃতীয় জনের ফুফু। হুজুর (সা.) হুনায়ন যুদ্ধে তাঁর পূর্বপুরুষের নাম গর্বের সাথে উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আনা আননাবীয়্যূ লা কাজেব আনা ইবন্ ুআবদিল মোত্তালেব।’ অর্থাৎ ‘আমি মিথ্যা নবী নই, আমি আবদুল মোত্তালেবের পুত্র।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জননীকুলের গর্ব করেছেন, ওই তিন জনের মধ্যে দুইজনই ছিলেন বনু সুলায়ম গোত্রের নারী। হুজুর (সা.) এ গোত্রের লোকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন এবং যথাযথ মর্যাদা প্রদান করতেন এবং এ গোত্রও এ সম্পর্ক সূত্রে গর্ববোধ করতেন। তারা আরো বিভিন্ন কারণে ও গর্ববোধ করতেন। কেননা তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বনু সুলায়ম গোত্রকে বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা প্রদান করেছেন। যেমন, মক্কা বিজয়ের দিন এ পরিবারের এক হাজার সদস্য হুজুর (সা.)-এর সহযাত্রী হয়েছিলেন।
তাদের জন্য আরো গৌরবের বিষয় ছিল যে, মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ (সা.) সকল ঝান্ডা (পতাকা) এর অগ্রভাগে রাখেন বনু সুলায়মকে এবং তাদের পতাকা ছিল লাল বর্ণের। পরবর্তীকালে হজরত উমর (রা.) এবং খেলাফত আমলে তিনি কুফাবাসী, সিরিয়াবাসী, বসরাবাসী এবং মিসরবাসীকে এই মর্মে পত্র দেন যে, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তিকে আমার নিকট প্রেরণ করো।’ সুতরাং, কুফাবাসীরা উত্তবা ইবনে ফারকাদ সালমীকে সিরিয়াবাসীরা, আবুল আওয়াব সালমীকে, বসরাবাসীরা মোজাশে ইবনে মাসউদ সালমীকে এবং মিসরবাসীরা মান ইবনে ইয়াজিদ সালমীকে খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর দরবারে প্রেরণ করেন।
উম্মাহাতুন্নবী ‘আওয়াতেক’-এর প্রতি এবং তাদের বংশ বনু সুলায়মের লোকদের প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরম ভক্তি, সম্মান এবং তাদেরকে মর্যাদা দানের ঘটনাবলি হুজুর (সা.)-এর মাতৃবংশ গৌরব প্রদর্শনের অপূর্ব দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। গৌরবমন্ডিত নবী (সা.)-এর প্রতি হাজারো দরুদ ও সালাম এবং তাঁর গৌরবান্বিত বংশের প্রতিও হাজারো সালাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন