দীন ইসলামের নৈতিক শিক্ষার অন্যতম উপকরণ হচ্ছে তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর ওপর ভরসা করা। একজন খাঁটি মুসলমানের অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে, সকল অবস্থায় আল্লাহর ভরসা করে চলা। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আর তোমাদের উচিত আল্লাহর ওপর ভরসা করা, যদি তোমরা খাঁটি মুমিন হও।’ -সূরা আল মায়িদাহ : আয়াত ২৩। অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘অবশ্যই আল্লাহ পাক তাওয়াক্কুলকারী বান্দাহদের ভালোবাসেন।’ -সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৫৯। মহান আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেছেন : ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ -সূরা আত্তালাক : আয়াত ৩।
নমরুদ ও তার সহচররা হযরত ইব্রাহীম আ.-কে চড়কে বা নিক্ষেপণ যন্ত্রে বেঁধে প্রজ্বলিত অনল কুন্ডে নিক্ষেপ করার প্রাক্কালে তার জবান মুবারক হতে উচ্চারিত হয়েছিল : ‘আল্লাহই আমার সহায়তার জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই উত্তম কর্ম বিধায়ক। এই তাওয়াক্কুলের ফলে মহান আল্লাহ পাক অনলকুন্ডের প্রতি নির্দেশ প্রদান করলেন, ‘হে অনলকুন্ড, তুমি ইব্রাহীমের প্রতি শান্তিদায়ক ঠান্ডায় রূপান্তরিত হয়ে যাও।’ -সূরা আল আম্বিয়া : আয়াত ৬৯। এতে স্পষ্টতই অনুধাবন করা যায় যে, যে সকল গুণে গুণান্বিত হলে একজন মানুষ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সান্নিধ্য ও নৈকট্য লাভে ধন্য হতে পারে তার মধ্যে আল্লাহর ওপর ভরসা করাই হচ্ছে প্রধান।
হাফেজ মোল্লা আলী ক্বারী এ প্রসঙ্গে বলেছেন : একজন মু’মিন মুসলমানের মুতাওয়াক্কিল বা আল্লহর ওপর ভরসাকারী হয়ে থাকাই বাঞ্ছনীয়। কেননা, এই দুনিয়ার যাবতীয় কাজ তথা ধন-সম্পদ, সৃষ্টি বা উপায় উদ্ভাবন, দান করা বা না করা, ক্ষতিকর কিছু হওয়া বা না হওয়া, ধনী-নির্ধন হওয়া, রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়া না হওয়া এবং জীবন-মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহ পাকের নির্দেশে সংঘটিত হয়ে থাকে। -মেরকাতুল মাফাতিহ : খন্ড ০৯, পৃ. ১৫৬, বৈরুত : ১৯৮৭।
বস্তুত, আল্লাহর ওপর ভরসা করার মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে সমৃদ্ধি লাভের পথ সুগম হয়ে ওঠে এবং পরকালীন জীবন উত্তম বিনিময় লাভ করা যায়। হযরত ওমর বিন খাত্তাব রা. হতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ওপর তোমরা যদি কায়মনে ভরসা করতে পার, তাহলে তিনি তোমাদের প্রয়োজনীয় রিজিক বা জীবনোপকরণ প্রদান করবেন। যেমন পশু-পাখিকে প্রদান করে থাকেন।’
আল কোরআনে মহান আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন : ‘পশু-পাখিরা প্রত্যুষে নিজ নিজ বাসা বা অবস্থান স্থান থেকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেরিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় পূর্ণ উদরে পরিতৃপ্ত হয়ে নিজ নিজ আবাসস্থলে প্রত্যাবর্তন করে। তাদের তাওয়াক্কুলের ফলেই আল্লাহ পাক এমন অনুগ্রহ করে থাকেন। -জামে তিরমিজী : খন্ড ০৭, পৃ. ৭। এই আলোচনার দ্বারা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর ওপর ভরসার মাধ্যমে সৃষ্টিকুলের যাবতীয় জীবনোপকরণ লাভের দরজা প্রসারিত হয়ে যায় এবং যাবতীয় অভাব-অনটন ও দুঃখ-দুর্দশা লাঘব হয়ে যায়।
কারণ, আল্লাহপাক সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং সকল বিশ্বের মালিক, অধীশ্বর। যখন তিনি কোনো কিছু করার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন বলেন, ‘হও’ তারপর তা হয়ে যায়। আল কোরআনে এই ঘোষণাই ঘোষিত হয়েছে : ‘আল্লাহ জাল্লা শানুহুর চিরন্তন ব্যবস্থা এমনই যে, ‘যখন তিনি কোনো কিছু করার মনস্থ করেন, তখন বলেন ‘হও’ তারপর তা হয়ে যায়।’ -সূরা ইয়াসীন : আয়াত ৮২। তাই একজন মুমিন-মুসলমানের উচিত জীবনের সকল অঙ্গনে বা সকল অবস্থায় একান্তভাবে আল্লাহর ওপর ভরসা করা।
তবে তাওয়াক্কুল অর্থ চেষ্টা, সাধনা, কর্মতৎপরতা পরিহার করে আল্লাহর ওপর ভরসা করা নয়। বরং চেষ্টা ও সাধনাকে অব্যাহত রেখেই আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ইমাম গাজ্জালী রহ. বলেছেন, রিজিক ও সম্পদ অর্জনের জন্য দৈহিক চেষ্টা সাধনা পরিহার করা হারাম। মূলত আল্লাহর ওপর ভরসা করে ব্যক্তি তার চেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যাবে, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তার চেষ্টা মাফিক বিনিময় প্রদান করবেন।
ওপরে উল্লিখিত হযরত ওমর বিন খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত হাদিসটির মর্মোদঘাটন করতে গিয়ে ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন, এই হাদিসে সমৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা না করার কথা উল্লেখ করা হয়নি, বরং সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য চেষ্টা-সাধনা চালিয়ে যাওয়ার প্রতি তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। এ জন্য পশু-পাখিরা নিজেদের চেষ্টা অব্যাহত রেখে দিন শেষে উদরভর্তি অবস্থায় আবাসস্থলে ফিরে আসে। -তুহফাতুল আহওয়াজী শরহে জামে তিরমিজী : খন্ড ০৭, পৃ. ৮।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন