আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার। আযানের সূচনা ধ্বনি। প্রতিদিন আমরা পাঁচবার এই আযান ধ্বনি শুনে থাকি। আযান ধ্বনিগুলোর অর্থ সবাই না বুঝলেও এ কথা সবাই বুঝে যে, এখন নামাযের সময় হয়ে গেছে। একটু পরেই জামাত শুরু হবে। তথাপি আযানের রয়েছে গূঢ় অর্থ ও মর্ম।
মর্ম ও তাৎপর্য : দুনিয়াতে অনেক কিছুই আছে বড়। রয়েছে বড়ত্বের অহমিকা ও দম্ভ। কিন্তু আল্লাহর বড়ত্ব সব কিছুকে ছাপিয়ে। দুনিয়াতে কোনো কিছুকে বা কাউকে বড়ত্ব তিনিই দান করেন। মহা মহীম সেই আল্লাহর মহিমা ও বড়ত্ব দিয়ে সূচনা হয় আযান ধ্বনির। মানুষ যেন বিনয়াবনত হয় আল্লাহর বড়ত্বের কথা ভেবে। এরপর রয়েছে তাওহীদের সাক্ষ্য। তাওহীদের বিশ্বাস মানুষকে করে দেয় সবচেয়ে দামি, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী।
এরপর আযানের ধ্বনিতে রয়েছে রিসালাতের সাক্ষ্য। রিসালাতের সাক্ষ্য ছাড়া তাওহীদের সাক্ষ্য অর্থহীন। উভয় সাক্ষ্য মিলে ঈমান পূর্ণ হয়। রিসালাতের সাক্ষ্য আমাদের এই বার্তাই দেয় যে, পৃথিবীর অন্য কোনো পথ ও মতে প্রকৃত সফলতা ও কামিয়াবী নেই। দৃশ্যত যতই তা যুক্তিযুক্ত ও হৃদয়গ্রাহী হোক না কেন। সুতরাং রাসূলের অনুসরণই আমাদের শিরোধার্য।
উপরন্তু এতে আরো রয়েছে নামায ও কল্যাণের দিকে আহ্বান। তাওহীদ ও রেসালাতের পরই নামাযের স্থান। হযরত উমর রা. বলেছেন, আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে নামায। আযানের শব্দ বিন্যাসেও সেই ধারাক্রম রক্ষা করা হয়েছে। কল্যাণ-গ্রহণ মানুষের স্বভাবজাত প্রেরণা। কিন্তু তাওহীদ, রিসালাত ও নামাযের কল্যাণের দিকে আহ্বান এই তাৎপর্যই বহন করে যে, জাগতিক ও পারলৌকিক কল্যাণ আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশনার মধ্যেই নিহিত। শুধু নিজস্ব মেধা ও বোধ-বুদ্ধি এ ক্ষেত্রে বিচার্য নয়।
তারপর আযানের শব্দে পুনরায় এসেছে আল্লাহর বড়ত্বের উচ্চারণ। মানুষ যেন কখনোই অহংবোধে পতিত না হয় সে জন্য আল্লাহর বড়ত্বের কথা বার বার। অহমিকা এতই জঘন্য যে, তা মানুষকে সত্য গ্রহণে বাধা প্রদান করে।
অবশেষে তাওহীদের বাণী পুন: উচ্চারণের মধ্য দিয়ে আযান শেষ হয়। মানুষ যেন সর্বদাই তাওহীদের বিশ্বাসে অটল থাকে। তাওহীদের বিশ্বাস নিয়েই যেন তার জীবনের শুভ সমাপ্তি ঘটে।
ইসলামের শুরুর দিকে মুমিনদের কিভাবে নামাযের জন্য একত্র করা হবে- এ বিষয়ে আল্লাহর রাসূল সা. সাহাবীদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেছেন। বিভিন্ন সাহাবী বিভিন্ন রকম মত দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল নানা কারণে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় সেসব মত খন্ডন করেছেন।
অবশেষে জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে স্বপ্নযোগে এক সাহাবী আযাানের শব্দগুলো জানতে পারলেন। নবী সা. শুনে তা সমর্থন করলেন। তো আযানের কালিমাগুলো সম্পূর্ণরূপে ঐশী নির্দেশনাপ্রসূত। এবং আল্লাহর রাসূল কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আযান কতটা গুরুত্ববহ- আযানের শুরুতেই তা স্পষ্ট।
আযানের গুরুত্বের আরেকটা দিক এটাও যে, আযান শুধু শ্রবণের জন্য নয়। প্রত্যেক শ্রোতাকে তার জবাব দিতে হয়। মৌখিক জবাবের পাশাপাশি সবচেয়ে মর্মবহ জবাব হচ্ছে আযান শুনে মসজিদে গমন করা। সর্বোপরি আযান হচ্ছে নামাযের আহ্বান। আর নামাযের গুরুত্ব যে সর্বাধিক তা বলাই বাহুল্য।
হযরত উমর ফারুক রা. থেকে বর্ণিত : তোমাদের সব বিষয়ের মধ্যে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সালাত। যে তা রক্ষা করেছে অথবা বলেছেন যে, এ ব্যাপারে যত্মবান হয়েছে সে তার দ্বীনকে রক্ষা করেছে। আর যে তা ধ্বংস করেছে সে অন্যান্য ব্যাপারে আরো বিধ্বংসী। (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস ৬)।
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেছেন, মানুষ যদি আযান ও প্রথম কাতারের ছাওয়াবের কথা জানত তাহলে লটারি করে হলেও তা অর্জনের চেষ্টা করত। (সহীহ বুখারী, হাদিস ৬১৫, ২৬৮৯)। হযরত মুআবিয়া রা. থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেছেন, কেয়ামতের দিন সুদীর্ঘ গ্রীবার অধিকারী হবে মুআযযিনগণ। (সহীহ মুসলিম, হাদিস ৩৮৭)।
অন্য হাদিসে নবী সা. বলেছেন, যে ব্যক্তি ছাওয়াবের প্রত্যাশায় সাত বছর আযান দেবে তার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তি লেখা হবে। (জামে তিরমিযী, হাদিস ২০৪)। নবী সা. আরো বলেছেন, ইমাম জিম্মাদার, মুয়াযযিন আমানতদার। হে আল্লাহ! আপনি ইমামদের সঠিক পথে পরিচালিত করুন। আর মুয়াযযিনদের ক্ষমা করুন। (সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদিস ১৫৩১-১৫৩২)। এছাড়াও আযানের অনেক ফজিলত হাদিসে বিবৃত হয়েছে, যা আযানের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেয়।
আযান থেকে আমরা অনেক শিক্ষা পেয়ে থাকি। যেমন- আল্লাহর বড়ত্ব স্বীকার করা, বর্ণনা করা। ঈমান-আক্বীদার হেফাজত করা। ঈমানের নবায়ন করা। নামাযের দিকে, কল্যাণের পথে দাওয়াত দেয়া। তাওহীদের বিশ্বাসকে খালিছ করা এবং অব্যাহত রাখা।
শেষকথা, পৃথিবীতে বহু ধর্ম আছে। প্রত্যেক ধর্মের রয়েছে ইবাদত-উপাসনার নিজস্ব পদ্ধতি। কিন্তু নামাযের দিকে আহ্বানের এই পদ্ধতি ‘আযান’ এক অনন্য অনুপম আদর্শ। তাৎপর্যমন্ডিত এক শিক্ষা ও ঐশীপ্রেরণাজাত এক নিদর্শন। যার নজির আর কোথাও নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন