বিশ্ব দুলালী নবী নন্দিনী খাতুনে জান্নাত ফাতিমাতুজ জাহরা রা. ইসলাম জগতের এক অবিস্মরণীয় মহীয়সী নারী। কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় যে সকল রমণীকূলের জীবন কথা স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে তিনি তাদের সম্রাজ্ঞী এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। তিনি ছিলেন বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মাদ সা. এবং তার প্রথমা পত্মী হযরত খাদিজাতুল কুবরা রা. এর কন্যা। হিজরতের এগারো বছর পূর্বে সম্ভবত ৬০৫ খ্রিস্টাব্দে মক্কা নগরীতে তার জন্ম হয়। তার শৈশবকাল পিতা-মাতার স্নেহ, মমতা, শিক্ষা ও আদর্শের ভেতর দিয়েই অতিবাহিত হয়।
প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর হিজরতের পর তিনি হযরত আলী রা. অথবা হযরত যায়েদ বিন হারিস রা.-এর তত্ত্বাবধানে মদিনায় হিজরত করেন। মদিনায় তিনি রাসূলুল্লাহ সা. কর্তৃক লালিতা, তার হাতে শিক্ষাপ্রাপ্তা, নারী জাতির আদর্শ স্থানীয়া, সকল প্রকার জান্নাতি গুণাবলীতে বিভূষিতা, পরলোকের শ্রেষ্ঠ আদর্শ মহিলা রূপে গড়ে উঠেন। হিজরি দ্বিতীয় সালে বদর যুদ্ধের পর শেরে খোদা হযরত আলী রা.-এর সাথে তার বিবাহ হয়। মতান্তরে উহুদের যুদ্ধের পর এই বিবাহ সংঘটিত হয়েছিল।
তার পুত্র হযরত হাসান রা. এবং হুসাইন রা. সম্ভবত চতুর্থ এবং পঞ্চম হিজরিতে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার তৃতীয় পুত্র মুহাসসিন শৈশবেই মৃত্যুবরণ করেন। তার দু’টি কন্যার নাম হযরত যয়নাব রা. ও হযরত উম্মে কুলসুম রা.। হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা রা.-এর জীবনাবসানের অব্যবহিত পূর্ব বছর হযরত উম্মে কুলসুমের জন্ম হয়েছিল। এই নিরিখে স্পষ্টতই বলা যায় যে, বিবাহিত জীবনের নয়-দশ বছরে তিনি তিন ছেলে ও দু’মেয়ের মাতৃত্বের আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। যাদের মাধ্যমে মোহাম্মাদ সা. অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সা.-এর রক্ত¯œাত বংশধারা কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ সা.-এর অপত্য স্নেহ, মায়া, মমতা ও সান্নিধ্যের নৃত্য চপল ঝর্ণা ধারা খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমাতুজ জাহরা রা. কে কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই আবর্তিত হতো। তিনি খাতুনে জান্নাত রা. কে কলিজার টুকরা হিসেবে খুবই ভালোবাসতেন। ইহকালিন জীবন ও পরকালীন জীবনের বহু গোপন তথ্য ও তত্ত¡ তার কাছে প্রকাশ করতেন। অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয় কালে খাতুনে জান্নাত রা. রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গে ছিলেন।
একটি হাদিসের আলোকে জানা যায় যে, আল-কোরআনের সূরা ‘নাসর’ নাজিল হওয়ার পর প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. তার কন্যাকে নিভৃতে ডেকে বললেন যে, তার ইন্তেকাল সন্নিকটে। হযরত ফাতিমা রা. কাঁদতে লাগলেন। এ দৃশ্য অবলোকন করে তিনি তাকে চুপে চুপে বললেন আমার পরিজনদের মধ্যে তুমিই আমার সাথে (পরজগতে) সর্বাগ্রে মিলিত হবে। এ কথা শুনে হযরত ফাতিমা রা. কান্না ভুলে হাসতে লাগলেন।
বিশ্ব দুলালী হযরত ফাতিমাতুজ জাহরা রা. ছিলেন ‘আসহাবুল কাসা’ অর্থাৎ জামার দ্বারা আবৃতজনদের অন্যতম। আরবি ভাষায় কাসা বলতে পরিহিত জামাকে বোঝানো হয়। রাসূলুল্লাহ সা. নাজরানবাসী খ্রিস্টানদের প্রতিনিধি সংঘের সাথে মুবাহালায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
এতদপ্রসঙ্গে আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এই সত্য তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে এসেছে। সুতরাং সংশয়বাদীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ো না। তোমার নিকট জ্ঞান আসার পর যে কেউ এ বিষয় তোমার সাথে তর্ক করে তাকে বলো: এসো, আমরা আহ্বান করি আমাদের পুত্রগণকে ও তোমাদের পুত্রগণকে, আমাদের নারীগণকে ও তোমাদের নারীগণকে, আমাদের নিজেদেরকে ও তোমাদের নিজেদেরকে, তারপর আমরা বিনিতো আবেদন করি এবং মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ বর্ষণকারী । নিশ্চয়ই এটা সত্য বৃত্তান্ত, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম প্রতাপশালী, প্রজ্ঞাময়। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৬০-৬২)।
এই মুবাহালায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ সা. গমনকালে স্বীয় কাসা বা জামার দ্বারা হযরত ফাতিমা রা., হযরত আলী রা., হযরত হাসান এবং হুসাইন রা. কে যুগপতভাবে আবৃত করে বলেছিলেন, এরাই আমার পরিজন। এই চারজনকেই সঙ্গে করে তিনি মুবাহালায় অবতীর্ণ হয়ে ছিলেন। কিন্তু খ্রিষ্টান পাদ্রীগণ মুবাহালা হতে বিরত থাকেন এবং যিজিয়া কর দিতে স্বীকার করে সন্ধী করতে বাধ্য হন।
খাতুনে জান্নাত ফাতিমাতুজ জাহরা রা. ছিলেন পরম জ্ঞানী, গুণী ও বিদুষী মহিলা। তার মাঝে আল্লাহ প্রেমের জোয়ার ধারা ছিল সর্বদাই বিদ্যমান। এজন্য তাকে বতুল অর্থাৎ পবিত্রা রমণী, যিনি কেবল আল্লাহর সাথে সার্বিক সম্পর্ক স্থাপনে তৎপর এবং জাগতিক অস্থায়ী সম্পর্ক ছিন্ন করতে অগ্রণীর ভ‚মিকা পালনকারী উপাধিতে বিভূষিতা ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সা.-এর সন্তানদের মধ্যে একমাত্র খাতুনে জান্নাত ফাতিমাতুজ জাহরা রা.ই তার জীবনাবসান পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। বিশ্ব নবী সা.-এর ইনতিকালের ছয়মাস পর হিজরি একাদশ সালের ২৮ শে রবিউস সানি তারিখে তার ইন্তেকাল হয়। তিনিই পরকালীন জীবনে সইয়্যেদাতুন নিসা-ই আহলিল জান্নাহ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন