মুমিন-মুসলমানদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একান্তভাবে আল্লাহতায়ালাকে ভালোবাসা ও মহব্বত করা। সে ভালোবাসা হবে নিষ্কাম, নিষ্কলুষ ও পুতঃপবিত্র।
যে মহব্বত, ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা নিছক আল্লাহর জন্য হয় তা সহোদর ভ্রাতৃত্বের চেয়ে কোনো অংশে দুর্বল ও ভঙ্গুর হয় না। এই বিশেষত্বটির অর্থ ও মর্ম অনুধাবন করার জন্য নিম্নের ঘটনাটি উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি। ১৯৬৩ সালে আমি যখন মাদ্রাসা-ই আলিয়া ঢাকা’র কামিল হাদিস বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হযরাতুল আল্লামা শাবান মিসরী রহ. ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন। আরবি সাহিত্যে প্রেম ও ভালোবাসা শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি বলেছিলেন: শেষ বিচারের দিন দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব ও আন্তরিকতা, মহব্বত ও ভালোবাসার ওপর নির্ভরশীল হবে। তারা সমান মর্তবা ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। এমনকি, যদি তাদের কোনো একজন মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে নিম্নস্তরে থাকে, তাহলে অপর জনের সুপারিশে উভয়েই সমপর্যায়ে উন্নীত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবে।
কেননা, আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি ও রেজামন্দির জন্য প্রতিষ্ঠিত বন্ধুত্ব, ভ্রাতৃত্বের মতই সুদৃঢ় ও পাকাপোক্ত হয়। সে দিন ধার্মিক পিতা-মাতার সুপারিশ যেমন সন্তানের জন্য কবুল করা হবে এবং সন্তানের স্তরকে পিতা-মাতার স্তরের সমান করে দেয়া হবে তেমনি সন্তানদের একজনের সুপারিশ অন্যজনের মর্যাদা ও মর্তবা বৃদ্ধির কারণ বনে যাবে। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে দিক-নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে: ‘আমি (শেষ বিচারের দিন) তাদের সন্তানদের তাদের সঙ্গে মিলিত করে দেব এবং তাদের কর্মফল মোটেই হ্রাস করব না।’ (সূরা তুর : আয়াত ২১)।
আল্লামা শাবান মিসরী রহ. এই আয়াতে কারীমা বার বার তিলাওয়াত করছিলেন এবং তার দু’কপোল বেয়ে অঝোর ধরায় তপ্ত অশ্রু ঝরে পড়ছিল। এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে অগণিত নেক বান্দাহদের তিলাওয়াত শ্রবণ করার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু তিলাওয়াতের সথে সাথে এভাবে অশ্রু বর্ষণের চিত্র আমি আর কোনোদিন দেখিনি।
অন্য এক হাদিসে এসেছে, সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত তার রহমত ও করুণার ছায়াতলে স্থান দান করবেন, যেদিন তার ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না। তাদের একজন হলো, ন্যায় পরায়ণ শাসনকর্তা। দ্বিতীয়জন হলো সেই যুবক, যে আল্লাহর এবাদত বন্দেগির ভেতর দিয়ে লালিত হয়। তৃতীয়জন হলো সেই ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে সংযুক্ত থাকে, অর্থাৎ মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর পুনরায় মসজিদে প্রবেশ করা পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে। চতুর্থজন হলো সেই দু’ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বন্ধুত্ব করে। এই বন্ধুত্বের ওপরই মিলিত হয় এবং এই বন্ধুত্বের ওপরই একে অপরের নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। পঞ্চমজন হলো সেই ব্যক্তি, যে গভীর অনুরাগের সাথে আল্লাহপাকের জিকির করে। অতঃপর দুই চক্ষু অশ্রু সজল হয়ে যায়। ষষ্ঠজন হলো সেই ব্যক্তি, যাকে সম্ভ্রান্ত ও চিত্তমোহিনী নারী প্রেম নিবেদন করে। অতঃপর সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সপ্তমজন হলো সেই ব্যক্তি, যে এমন গোপনীয়তাসহ দান-খয়রাত করে যে, তার বাম হাতও জানতে পারে না ডান হাত কী দান করল। (সহীহ মুসলিম)।
বস্তুত: মহব্বত ও ভালোবাসা যখন স্বচ্ছ, পবিত্র ও নিষ্কলুষ হয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তার প্রতিদান প্রদান করেন। হাদিস শরীফে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি তার কোনো আন্তরিক ও অকৃত্রিম বন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাত্রা করল। আল্লাহপাক তার অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য একজন ফিরিশতা প্রেরণ করলেন। সে জিজ্ঞেস করল: কোথায় গমন করছ? লোকটি বলল, আল্লাহর ওয়াস্তে এক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছি। ফিরিশতা বলল: তার নিকট কোনো দরকার আছে কি? লোকটি বলল: না। ফিরিশতা পুনরায় জিজ্ঞেস করল: তুমি কি আত্মীয়? সে বলল: না। ফিরিশতা পুনরায় জিজ্ঞেস করল: তবে কি তুমি তার কোনো অনুগ্রহ ও উপকারের প্রতিদান দিতে মনস্থ করেছ? লোকটি বলল: না। পরিশেষে ফিরিশতা বলল: তোমার গমনের কোনো কারণ তো অবশ্যই আছে? লোকটি বলল: কারণ হলো- আমি আল্লাহর ওয়াস্তে তাকে ভালোবাসি। একথা বলার সাথে সাথে ফিরিশতা বলতে লাগলো- তবে শোন, আল্লাহপাক সংবাদ দিচ্ছেন যে, এহেন আন্তরিক মহব্বত ও ভালোবাসার প্রতিদানে আল্লাহপাকও তোমাকে ভালোবাসেন। তিনি তোমার জন্য জান্নাত অবধারিত করে রেখেছেন। (সহীহ মুসলিম)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন