কয়েক ঘণ্টা রেলে ভ্রমণ করে কোনো মানুষজন না দেখা, দেখলেও হাতে গোনা, কখনো কখনো এমন বিষয় বাংলাদেশে ভাবাও যায় না। ট্রেন সুপার ফাস্ট থাকায়, কিছু স্টেশন ধরেনি। আসলে স্টেশনও তেমন নেই। তাশকন্দ থেকে বোখারা যাওয়ার পথে বড় স্টেশন সমরকন্দ।
এছাড়া সম্ভবত আর দু’টি স্টেশনে ট্রেনটি মিনিট তিনেকের জন্য থেমেছিল। সারা পথে এত কম মানুষ আমরা দেখেছি, যা কল্পনা করতেও বুকটা খালি খালি লাগে। মনে হয়, হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে আমরা দু’চারশ’র বেশি মানুষের দেখা পাইনি।
কোথাও হয়তো দু’জন কৃষক দেখেছি। চারজন শ্রমিক দেখেছি। ৮/১০ জন মানুষ একসাথে কোথাও কোনো পারপাসে জমা হয়ে আছে এমন দেখা যায়নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গ্যাসফিল্ড, কল-কারখানা, প্রজেক্টে হয়তো মানুষ থেকে থাকবে, কিন্তু দৃশ্যমান দু’একজনের বেশি নয়। একটি পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন ও শান্ত সমাহিত দেশ।
মানুষ জোরে কথা বলে না। কেউ কাউকে ঘাঁটায় না বা বিরক্ত করে না। ব্যক্তিগত স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য বোঝে। এটি মহান ইসলামের এক পবিত্র শিক্ষা। যা আজ মুসলমানরা অনেকাংশেই হারিয়ে বসেছে। এ ধরনের আদবকায়দা ও সুখকর সহাবস্থান ইসলামের গৌরবজনক উত্তরাধিকার।
সারা পৃথিবীকে ইসলাম এসব শিখিয়েছিল। আর আজ দুনিয়া শিখে নিয়েছে, ইসলামের অনুসারীরা এ সবক সম্পূর্ণ ভুলে গেছে। আধ্যাত্মিক জগত আল্লাহর পরিচয়ের পর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, সৃষ্টির সেবা ও শান্তি। যার মধ্যে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বস্তিজনক আচরণ প্রধান বিষয়। একসময় বোখারা পৌঁছল গাড়ি। রেল স্টেশনটি যেন ছোটখাটো একটি রাজবাড়ি।
আমাদের বরণ করার জন্য অনেক আবেগ-অনুভ‚তি নিয়ে হাস্যোজ্জ্বল বহু চেহারা যেন ফুল হয়ে ফুটে আছে। এত উষ্ণ অভ্যর্থনা সব জায়গায় হয় না। এদেশের অনেক জায়গা আর মুসলিম বিশ্বের কোনো কোনো দেশে এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। বাংলাদেশি টিমের সাথে আরও ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়াসহ অনেকগুলো আরব দেশের পীর মাশায়েখ ও তরিকার লোকজন।
যুগ যুগান্তরের আত্মীয়কে মানুষ যেভাবে জড়িয়ে ধরে, মাথায়, কপালে, টুপিতে, ঘাড়ে, পিঠে, জামার আস্তিনে চুমু খাওয়া, জামার ঝুল, কাঁধের রুমাল তুলে নিয়ে চেহারায় ঠোঁটে, মুখে, চোখে লাগানো দেখে চোখে পানি এসে যায়। এরা আমাদের এতই আপন মনে করে। ধর্মীয় আবেগ থেকে এত শ্রদ্ধা করে। ব্যাগপত্র যে কারা নিয়ে গেল, টেরই পেলাম না। আমরা গাড়ি পর্যন্ত যেতে যেতে কয়েকশ’ ক্যামেরার শিকার হয়েছি। শুধু তাই নয়, যুবকরা আমাদের চলার ভিডিও এতই শৈল্পিকভাবে করছিল, যেন এরা অস্কার পাওয়ার জন্য ফিল্ম তৈরি করছে।
আমাদের হেঁটে চলা, হাত নাড়ানো, মানুষের সাথে মোসাফাহা, গাড়িতে বসা, এমনকি গাড়ি রাস্তায় চলছে -এ দৃশ্যও হোটেল পর্যন্ত আধুনিক শিক্ষিত তরুণরা অন্য গাড়িতে করে তুলছিল। কখনো রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কাত হয়ে, আইল্যান্ডে উঠে এই যাত্রাটি তারা ছবিতে ধরে রাখছিল। তাদের এ আবেগ মূলত তিন প্রজন্মের কষ্টের ফসল।
১৯১৭ সালে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে দ্বীন, ঈমান, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতা হারানো উজবেকিস্তান ৭৫ বছর পর নতুন করে স্বাধীনতা অর্জন করে। মোটামুটি ১৯৯১ থেকে তারা কমিউনিস্ট শাসনের নিগঢ় থেকে মুক্তি লাভ করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন