জ্ঞানীদের মুখে ও নানা বইপত্রে এ কথাটিও পাওয়া যায়, ইমাম মুহাম্মাদ বাহাউদ্দীন নকশবন্দকে এ জন্য নকশবন্দ বলা হয় যে, তিনি যে বংশের লোক ছিলেন তারা কাপড়ে নকশা তৈরির কাজ করত। বোখারায় এ নকশবন্দ গোত্রের আবাস।
অনেকে বলেন, ইমাম বাহাউদ্দীন নিজেও নকশার কাজ করতেন। আমার তা মনে হয় না। কারণ ইমামের জীবন সম্পর্কে যতদূর জেনেছি তিনি আল্লাহকে পাওয়ার জন্য সবসময় ইবাদত বন্দেগিতে মগ্ন থাকতেন। এক সময় তার মা তাকে বললেন, বৌ-বাচ্চাদের জন্য কিছু উপার্জনের লক্ষ্যে যেন ইমাম বোখারার কসরে আরেফান ছেড়ে সমরকন্দে যান। সেখানে গিয়ে তিনি শ্রমিকের কাজ করবেন বলে ভেবে রওনাও হয়ে যান।
পথে এক মসজিদে নামাজ শেষে বেরুনোর পথে দেখতে পান একটি কবিতার লাইন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘বন্ধু তোমার সাথে দেখা হওয়ার সময় হয়েছিল। তুমি আরেকটু ধৈর্য ধরলেই আমাকে পেতে।’ মসজিদের দেয়ালে অজ্ঞাত কবির এ দু’টি লাইন পড়ামাত্রই তার জীবিকা উপার্জনের জন্য সমরকন্দ যাওয়ার ইচ্ছা চলে যায়।
তিনি অর্ধেক রাস্তা থেকেই আবার বোখারায় ফিরে যান। মসজিদে চিল্লায় বসেন এবং কিছু দিনের ভেতরেই নতুন তরিকার রূপরেখা তার অন্তরে উদিত হয়। তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ চার কর্মপদ্ধতি বা তরিকার একটি প্রবর্তন করে উম্মতের নবজাগরণের নকিব হয়ে দেখা দেন।
তিনি যদি নিজেই নকশার কাজ করতেন তাহলে সমরকন্দে শ্রমবিনিয়োগের জন্য কেন যেতে ইচ্ছা করতেন। অন্য একটি মত এমন আছে যে, তিনি মানুষের অন্তরে আল্লাহ নামের নকশা এঁকে দিতেন। এজন্য লোকে তার নাম দেয় নকশবন্দ। এটি এমনও হতে পারে যে, তিনি কারো বুকে আঙুল রেখে আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ পড়তেন আর লোকটির কলবে জিকির জারি হয়ে যেত।
আত্মিকভাবে লোকেদের কলবকে আল্লাহর সার্বক্ষনিক জিকিরের সাথে যুক্ত করে দিতেন। এ সব যে কোনো কারণে তাকে নকশবন্দ বলা হয়। তার পদ্ধতির অনুসারীদের বলে নকশবন্দী। আটলান্টিক থেকে সূর্যোদয়ের দেশ পর্যন্ত তখন নকশবন্দী তরিকা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বিশ্বের প্রতিটি জনপদে এ তরিকার সুফল, ফয়েজ, কার্যক্রম ও অনুসারী পাওয়া যায়।
বোখারা পেশম, সিল্ক ও সূতার তৈরি কাপড়, চাদর, পোষাক, কার্পেট, কুশন ইত্যাদির জন্য বহু শতাব্দী ধরে বিখ্যাত। এর অনুসঙ্গ হলো নকশা ও কারুকাজ। তারা মনে করেন, বোখারার হস্তশিল্প ও নকশার বিখ্যাত গ্রাম কিংবা মহল্লার বাসিন্দা হিসেবেও কি ইমাম বাহাউদ্দীনের নাম নকশবন্দী হতে পারে না।
এ যুক্তিটি বিশেষ শক্তিশালী নয়। কারণ, ইমাম বাহাউদ্দীনের মহল্লার নাম ছিল কসরে আরেফান। তাছাড়া তিনি ছাড়া আর কোনো ব্যক্তির নাম ইতিহাসে নকশবন্দ হিসেবে পাওয়া যায় না। পেশাগত পরিচয় হলে আরও অনেক নকশবন্দ থাকতেন। অবশ্য দুনিয়াতে তার পর থেকে তার তরিকার নাম হয়ে যায় নকশবন্দী। আর বহু মাশায়েখও নিজেদের নাম নকশবন্দের দিকে নিসবত করে রাখেন ‘নকশবন্দী’। এখানে আধ্যাত্মিক প্রভাবে মানুষের অন্তরে তিনি আল্লাহর নামের নকশা স্থায়ী করে দিতেন বলেই তার নাম নকশবন্দ এ কথাটি সবচেয়ে বেশি যুক্তিযুক্ত।
উজবেকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী প্রতিটি স্থাপনা, দুর্গ, প্রাসাদ, মিনার ও স্তম্ভে কারুকাজ দেখা যায়। নতুন বাড়ি ঘর স্থাপনা ও দেয়ালে অভিজাত হালকা এবং ইসলামী ভাবধারার নকশা। রংয়ের ব্যবহারও অত্যন্ত রুচিশীল। প্রতিটি মসজিদে সামান্য হলেও কাঠের কাজ।
বড় কাঠের স্তম্ভে নকশার কাজ। দরজা, খাট, পালং, সোফায় খুব সূ² নকশা ও কারুকাজ। খাজা বাহাউদ্দীন নকশবন্দী কমপ্লেক্সের মিউজিয়ামে শত শত বছরের পুরনো দরজা, দেউড়ি, পার্টিশন ইত্যাদি রক্ষিত আছে। সে সবে অত্যন্ত সূ² কারুকাজ ও নকশা। মাটির পাত্রে রং বেরংয়ের নকশা। চীনা মাটির পাত্রেও নকশা। টাইলসে নকশা। বোখারা সমরকন্দসহ উজবেকিস্তানের নারীদের পোষাকে কড়া বাহারি রংয়ের ব্যবহার ও প্রচুর কারুকাজ এবং নকশা।
এ সব নকশার প্রাচুর্য যে দেশটির বৈশিষ্ট্য, সেখানকার একদার রাজধানী ও প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে নকশবন্দ সম্প্রদায়ের পাড়ায় বসবাস করতেন বলে ইমাম মুহাম্মাদ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী বলাও কম যৌক্তিক নয়। যে পাড়া গ্রাম বা মহল্লার একটি সন্তান ইসলাম জগতের প্রধান চার তরিকার অন্যতম ইমাম হওয়ায় নকশবন্দ নামটি অমরত্ব ও বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছে। দুনিয়াজুড়ে ৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নকশবন্দী তরিকার কোটি কোটি অনুসারী রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন