ছোট বেলায় কখন, কোথায় যেন একটি ছড়ার বইতে পড়েছিলাম, ‘সদর ঘাটের অন্দরে/হাজার নায়ের বন্দরে, সবাই করে বেচা কেনা/আমার কপাল মন্দ-রে।’ এই সদর ঘাট বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ নৌ বন্দরগুলোর অন্যতম, যা বুড়িগঙ্গা নদীর উত্তর তীরে অবস্থিত।
সদর ঘাট বরাবর যারা বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ তীরে বা আরও দূরবর্তী এলাকায় বসবাস করেন, তাদের অধিকাংশই তেল ঘাট হয়ে নৌকা যোগে সদর ঘাটে পৌঁছেন। আমি ও তাদেরই একজন যারা রোজানা নদী পার হন। খেয়া নৌকায় বসে নদী জলের তুঙ্গ তরঙ্গে যখন আন্দোলিত হয়ে উঠি, তখনই মনের গহীন কন্দরে একটি নাম উঁকি মেরে উঠে, যার জ্ঞানাঞ্জন শলাকার মধুর পরশ আজও আমাকে সচকিত করে তুলছে। তার কথাই আজ আপনাদের কাছে খুলে বলব।
এলমে জাহের ও এলমে বাতেনের অবিস্মরণীয় কৃতিত্বের অধিকারী, মুফতি সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ আমিমুল ইহসান আল মোজাদ্দেদী আল বরকতী রহ.। হিজরি চতুর্দশ শতাব্দীর ও খ্রিষ্টীয় বিংশ শতাব্দীর এক কীর্তিমান বিশ্ববরেণ্য আলেমে দীন হিসেবে কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে রয়েছেন। এই ক্ষণজন্মা সুপুরুষ ২২ শে মুহাররাম ১৩২৯ হিজরি, মোতাবেক ২৪ শে জানুয়ারি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে বিহার প্রদেশের মুঙ্গের জিলার পাচনা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তার নাম মোহাম্মাদ, উপাধি আমিমুল ইহসান। এই উপাধিতেই তিনি সবিশেষ পরিচিত। তিনি মোজাদ্দেদী তরিকাভুক্ত সাইয়্যেদ আবু মোহাম্মাদ বারকাত আলী শাহ এর মুরিদ ও জামাতা ছিলেন বলে নিজ নামের সাথে মুজাদ্দেদী ও বরকতী এই দু’টি লকব যোগ করতেন। তার বংশ পরম্পরা সাইয়্যেদেনা হযরত হোসাইন রা. পর্যন্ত প্রলম্বিত। এই সুবাধে তিনি নিজেকে হোসাইনী সাইয়্যিদ বলে মনে করতেন।
তাছাড়া তিনি পাকিস্তানের লাহোর জেলার অন্তপাতি কুন্দিয়ান শরীফের প্রখ্যাত পীর কাইয়্যুমে জাসাস, কুতবে দাওয়ান হযরতুল আল্লামা আবু সায়াদ আহমাদ খান রহ.-এর দোয়া এযাজত ও তাওয়াজ্জুহের বদৌলতে সুলুকের অফুরন্ত আনওয়ার, ফুয়ূজ ও বারাকাত লাভে ধন্য হয়েছিলেন। আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ সাফল্যের সাথে নকশবন্দী ও মুজাদ্দেদী তরিকার অনুসরণ করতেন।
ওস্তাদুনা সাইয়্যেদ মুফতি আমিমুল ইহসান রহ.-এর পিতা হযরত মাওলানা হাকীম সাইয়্যেদ আবুল আযীম মোহাম্মাদ আব্দুল মান্নান রহ. কলিকাতার জালিয়া টুলী মহল্লায় বসতী স্থাপন করে সেখানে একটি মসজিদ, একটি দাওয়াখানা ও একটি হালকায়ে জিকর কায়েম করেন।
এখানেই বালক আমিমুল ইহসান মাত্র পাঁচ বছর বয়সে কোরআন মাজীদ খতম করেন এবং স্বীয় চাচা সাইয়্যেদ আবদুদ দাইয়্যান সাহেবের নিকট ফার্সী ও উর্দু ভাষা শিক্ষা করেন। অতঃপর কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেমের নিকট আরবি ভাষা, কোরআন শরীফ, হাদিস শরীফ, ফিকাহ শাস্ত্র, কালাম শাস্ত্র, মানতিক এবং তাসাউফের শিক্ষা লাভ করেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে শ্রদ্ধেয় পিতার মৃত্যুর পর মুফতি সাহেব মাত্র ২৬ বছর বয়সে তদস্থলে মসজিদ, দাওয়াখানা ও হালকায়ে জিকির পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কলিকাতা আলীয়া মাদ্রাসা হতে তিনি ১৯৩১ সালে ফাযিল ও ১৯৩৩ সালে কামিল (হাদিস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উভয় পরীক্ষাতে তিনি প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। অনন্তর তিনি অবসর সময়ে বিশেষ ব্যবস্থায় শাসমুল ওলামা মাওলানা ইয়াহইয়া সাহেবের নিকট ইলমে হাইআত, এবং শামসুল ওলামা মাওলানা সুলতান আহমাদ কাশপুরী সাহেবের নিকট মাকুলাত বিষয়াদি শিক্ষা লাভ করেন।
এলমে জাহের ও এলমে বাতেনের এই রত্ম ভান্ডার ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে কলিকাতার কুলুটোলাস্থিত ‘নাখোদা’ মসজিদের মাদরাসার প্রধান মুদাররিস পদে নিযুক্ত হন। পরবর্তী বছর (১৯৩৫ খ্রি.) তিনি সে মসজিদের দারুল ইফতা বা ফাতওয়া বিভাগের মুফতির পদে নিয়োগ লাভ করেন। তদানীন্তন বাংলার প্রাদেশিক সরকার তাকে ধর্মীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য এবং কাজির পদে নিযুক্ত করেন। এতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে তিনি পালন করেছিলেন। কখনও ক্লান্তি, শ্রান্তি এবং অবসাদ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন