সফরের মধ্যে এক জুমাবারে আমরা দেখতে যাই বোখারার উপকণ্ঠে একটি মহল্লা। এটি একটি পুরনো জনপদ। কমিউনিস্ট যুগে এখানকার ইসলামী নিদর্শন সব ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় কমরেডরা। সমাজতন্ত্র জোর করে নাস্তিকতা চাপিয়ে দেয় জনগণের ওপর।
গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম সরাসরি তুলা বাগান। ফসল তোলা হচ্ছে। সাদা সাদা তুলা ফুল তুলে ঝুড়িতে রাখছে কৃষক নারী-পুরুষ ও শিশুরা। পাকা রাস্তার ধারে ক্ষেত হলেও জায়গাটি একটি প্রশাসনিক ইউনিট। মূল সড়ক বিরাট চওড়া। একটি ফাঁড়ি সড়কের মুখে সুন্দর একটি মোটেল ও রেস্তোরাঁ। মডেল দেখে বোঝা যায় এসব হালাল পর্যটনের উন্নয়নের জন্য নির্মিত আধুনিক সরাইখানার একটি।
গাইডরা হেঁটে এগিয়ে চললেন একটি কমপ্লেক্সের দিকে। বিশাল নয়নাভিরাম গেট পার হতেই চোখে পড়ল অনেকগুলো বাগান। সবুজ পটে ফুটন্ত রং বেরংয়ের ফুল আর ফুল। নানা রকম গোলাপ। কয়েক রংয়ের পাপড়ি মেশানো নতুন ধরনের গাঁদা। নীল বেগুনি ফুল। সোনালি পাতার গাছ। লাল হলুদ, সাদা হলুদ পাতা ও পাপড়ির অচেনা অনেক গাছ ও ফুল।
কিছু দূরে দূরে ছোট বসার জায়গা। ত্রিকোণ কুঞ্জবন। ছাউনি, ঝাড়বাতি, বসার বেঞ্চি। দীর্ঘ সড়কের দু’পাশে ফুলের বেড। বসার জায়গা। একপাশে স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটি মিউজিয়াম। লোকশিল্প জাদুঘর টাইপের। কিছু কিতাব, পান্ডুলিপি, কৃষি যন্ত্রপাতি, জামা-কাপড়, নকশী করা কাপড় ইত্যাদিতে সুসজ্জিত। অপর পাশে বিশাল এক মসজিদ। এখনেই জুমা পড়ার সিদ্ধান্ত হয়। খাজা মাহমুদ আনজির ফাগনাভী রহ.-এর মাজারটি এ মসজিদের পাশে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা নকশবন্দী শায়খ পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী সাহেবও এ মসজিদে জুমা পড়বেন। তিনি এ পর্যন্ত আমাকে ইজাযত দানকারী বিশ্বের ১৩ জন শায়খ ও মুরব্বীর অন্যতম।
সোভিয়েত দখলমুক্ত নতুন উজবেকিস্তানে আমরা একটি জুমা দেখতে পেলাম। আশপাশ থেকে বহু মুসল্লী আসছেন। দূর দূরান্ত থেকেও অনেক মুসল্লী এসেছেন বলে মনে হলো। কিছুটা উপ-শহুরে জনপদ। সাইকেল চালিয়ে অনেক কৃষক ও শ্রমিক ধরনের নামাজী এসেছেন। সকলের গায়ে শীতের ভারি পোষাক। মাথায় উজবেক চারকোণা টুপি। কালো টুপির কোণাগুলোয় সাদা ফুলের প্রিন্ট। অনেকের মাথায় গরম রুশ ক্যাপ।
অপ্রচলিত রংয়ের অনেক ফুল দেখে আমি ছবি নিচ্ছিলাম। পেছন থেকে হংকং ইসলামিক সেন্টারের চেয়ারম্যান বন্ধুবর মাওলানা কারী তৈয়্যব সাহেব বললেন, লেখার জন্য রসদ জমা করা হচ্ছে না কি? হেসে জবাব দিলাম, ফুল পাতা গাছ প্রকৃতি ও অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনার ছবি নেয়া আমার অভ্যাস। আর বোখারা সমরকন্দ হচ্ছে স্থাপত্যকলার স্বর্গ।
একটি বেঞ্চিতে দু’জন বসলাম। ইনি বৃটিশ পাসপোর্ট নিয়ে চলেন। জন্ম পাকিস্তানে, থাকেন হংকং। পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান। বিদেশেই তার সাথে নানা জায়গায় ১০/১৫ বার দেখা। পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দীর খেলাফত ও ইজাযত আমরা দু’জনই একই বছর একই মজলিসে লাভ করি। আমাকে খুব মহব্বত করেন। মনীষীদের জীবনেতিহাসে তার দক্ষতা প্রচুর।
বসে আছি রোদের তাপে কিছুটা উষ্ণতার আশায়। ঠান্ডা বাতাসে হাত পা জমে যাচ্ছে। মাহমুদ আনজির কমপ্লেক্সে অনেক নারী শিশু ও প্রবীণরা জড়ো হয়েছেন জুমার দিনের ইবাদত করতে। আমাদের লেবাস পোষাক দেখে বাচ্চারা বাবা মাকে বলছে গ্রুপ ছবি তুলতে। টিমের অনেকে এ ডাকে সারা দিচ্ছেন। আমাদের ঘিরেও কিছু শিশু ছবি তোলে।
পৌনে শতাব্দীর কমিউনিস্ট লৌহ যবনিকার অন্তরালে তারা তাদের প্রাণের সুন্নাত ও সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলে। টুপি দাড়ি পাগড়ি জুব্বা বা শেরওয়ানি সমৃদ্ধ আলেম ওলামা পীর মাশায়েখ ও ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব সে দেশে বিরল। আবার এসব ছবি তাদের দাদী নানী মা বাবা এখনও মনের পটে সংরক্ষণ করে। শিশুদের কৌতুহলটি মূলত বের হয়ে আসে, ডিএনএতে প্রবাহিত ঈমান থেকে। তাদের জিনে সুরক্ষিত মহাব্বাত ও হৃদয়ের টান থেকে।
শিশুরা আমাদের ঘিরে যত আনন্দ ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে, আর দূরে বসে তাদের গার্জিয়ানরা এতে যে তৃপ্তি অনুভব করেছেন এসব আমরা বিরক্ত না হয়ে বরং উপভোগই করেছি। কারণ, যার নাই সেই বোঝে। আমাদের দেশে এসব সযতেœ লালিত আছে বলে সমাজে সম্ভবত ততটা কদর নেই। শ্রদ্ধাবোধ আছে বটে, তবে প্রাণের টান মেশানো অপত্য স্নেহ, মায়া-মমতা ও অশ্রুভেজা ভালোবাসা নেই। যা সোভিয়েত অত্যাচারিত অধুনামুক্ত মুসলিম মধ্য এশিয়ার দেশে দেশে দেখা যায়।
দু’জন মহিলা এসেছেন তেলের পিঠার ব্যাগ নিয়ে। সবার কাছে গিয়ে বলছেন, হাদিয়া নাও। নিতে হচ্ছে। কারী তৈয়ব সাহেব এবং আমি একটি করে পিঠা নিলে প্রবীণা দু’জন বললেন, আরো নিন। কমপক্ষে তিনটে। ভাষা বুঝিনি, তবে মর্ম ও ইশারা বুঝে তিনটি করেই নিলাম। চাল ও ময়দার রুটি কেটে টুকরোগুলো তেলে ভেজে এ পিঠা তৈরি। চিনি টিনি ছিলনা বলে আমরাও খেতে পারলাম।
মাজার কমপ্লেক্সে জিয়ারতে গিয়ে দেখি মূল দরজার দু’পাশে টেবিলে এ ধরনের পিঠার খাঁচা রাখা আছে। সবাই একটি দু’টি খাচ্ছেন। এটি জুমার দিনের তাবাররুক। এখানে প্রতি শুক্রবার এলাকার মানুষ পিঠা নিয়ে আসেন বলে জানতে পারলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন