উপহাসের প্রতিশোধ : মোগল খান কর্তৃক তৈমুরের মৃত্যুর পরওয়ানা জারি করার ঘটনা তৈমুরের জীবনে সবচেয়ে কঠিন সময় ডেকে আনে। প্রাণ রক্ষার জন্য তাকে প্রিয় স্ত্রীসহ অসংখ্য মরু বিয়াবান উভ্রান্তের ন্যায় অতিক্রম করতে হয়।
সে এক করুণ কাহিনী। আত্মরক্ষার জন্য এ পলাতক জীবনই তাকে চরম মোগল বিরোধী করে তোলে এবং দুঃখ-কষ্টের নানা ঘটনার পর তার ভগ্নিপতি আমির হোসেনসহ মোগলদের বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আফগানিস্তানের সাজেস্তানের শাসনকর্তার সাথে তুমুল যুদ্ধে তৈমুর সারা জীবনের জন্য একটি পা হারালেও যুদ্ধে তিনি জয় লাভ করেন। তখন থেকে তিনি ‘ল্যাংড়া তৈমুর’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। অতঃপর মোগলদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা আক্রমণ চালিয়ে তৈমুর বিজয়ের এক অধ্যায় শুরু করেন এবং সকল প্রতিবন্ধকতার সফল মোকাবেলা করে এক নব যুগের সূচনা করেন।
সমরকন্দ জয় করায় তৈমুর লং ইরান, ইরাক, ই¯পাহান, হিন্দুস্তান, সিরিয়া প্রভৃতি আরো বহু দেশ জয় করেন এবং অপ্রতিহত গতিতে তার বিশ্ব জয়ের অভিযান অব্যাহত থাকে। তার সর্বশেষ বিজয় অভিযানগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তুরস্কের আংকারা বিজয়। ঐতিহাসিকদের মতে, এর প্রধান কারণ ছিল উসমানীয় সুলতান বাইজিদ ইলদ্রিম তৈমুরকে ‘ল্যাংড়া’ বলে তার অবমাননা করেছিলেন, পরিণামে বাইজিদ তার হাতেই বন্দি হয়েছিলেন।
বিচারের কাঠগড়ায় তৈমুরতনয় : ইনসাফ তথা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে তৈমুর ছিলেন খুবই কঠোর। রাষ্ট্রের যে যত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিই হোক না কেন কারো প্রতি জুলুম-নির্যাতন করার অনুমতি তার ছিল না। এ ব্যাপারে তার আপন স্বজনদেরও তার কাছে জবাবদেহি করতে হতো এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে অবশ্যই যথাযথ শাস্তি ভোগ করতে হতো। উদাহরণস্বরূপ এ পর্যায়ে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
তৈমুরের তৃতীয় পুত্রের নাম মিরান শাহ। তাতারি রীতিপ্রথা অনুযায়ী, তিনি যুবরাজ হওয়ার অধিকারী ছিলেন। তৈমুর তাকে পশ্চিমাঞ্চলের গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন। তৈমুর যে সময় ভারত অভিযানে গমন করেছিলেন সে সময় মিরান শাহ কোনো কোনো চাটুকার ও মোসাহেবের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত হয়ে সেখানে স্বেচ্ছাচারিতা ও নির্যাতনমূলক আচরণ করেন।
তৈমুর হিন্দুস্থান হতে প্রত্যাবর্তন করার পর সব খবর জানতে পারেন এবং কালবিলম্ব না করে সরাসরি মিরানের শাসনাধীন সুলতানিয়ায় পৌঁছেন এবং দ্রুত মিরান শাহ ও তার মোসাহেবদের হত্যার নির্দেশ দেন। যখন সবার গলায় রশি লাগিয়ে তৈমুরের সামনে তাদেরকে হাজির করা হয় তখন আমির-ওমারা ও দরবারের নেতৃ স্থানীয়দের সুপারিশক্রমে মিরান শাহকে তৈমুর ক্ষমা করে দেন। তবে খাওয়ারেজম ও ইরানের শাসন ক্ষমতা হরণ করেন এবং তাকে আর পদ না দেয়ার ঘোষণা দেন।
তৈমুর ছিলেন পীর-দরবেশভক্ত। দরবেশ সৈয়দ জয়নুদ্দীনকে তিনি খুবই ভক্তি প্রদর্শণ করতেন এবং যৌবন কালে তার সান্নিধ্যে থেকে এবাদত বন্দেগি করতেন। বর্ণিত আছে, কাজগানের নিহত হওয়ার পর চুগতাই খান এশিয়া মাইনরে এসে ত্রাসের রাজত্ব আরম্ভ করেন। তখন এক রাত তৈমুর তার বুজর্গ পীরের সঙ্গে এবাদত ও পরামর্শে রাত কাটান এবং তার প্রদত্ত জিনিসপত্র তারই নির্দেশ অনুযায়ী মোগল খানকে পেশ করেন এবং খান তাকে ‘তুমান বাশী’ (দশ হাজারি) পদবীতে ভ‚ষিত করেন।
একই বুজর্গের নির্দেশ অনুযায়ী তৈমুর অপহৃত সৈয়দজাদীগণকে তরবারির জোরে মুক্ত করেছিলেন। আমির হোসেনের নিহত হওয়ার পর বালখে তাতারিদের গির্জায় নতুন আমির নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনার বিষয়বস্তু হলে উক্ত বুজর্গের জোরালো বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে সকল লোক তৈমুরকেই তাদের আমির মনোনিত করে। তাই সর্বদা তার নামের পূর্বে ‘আমির’ ব্যবহৃত হতে থাকে।
গবেষকদের দৃষ্টিতে তৈমুর : একজন বিখ্যাত পশ্চিমা গবেষক তৈমুর প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন: ‘ইতিহাস যুগে এশিয়ার কোনো ব্যক্তি নিজের শক্তির জোরে এমন কীর্তি স্থাপন করতে পারেনি, অপর কোনো ব্যক্তি সে স্থান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। কোনো কোনো সময় তার সাফল্যগুলো মানব শক্তির উর্ধ্বে দৃষ্টি গোচর হয়।’
তৈমুরের ব্যক্তিত্ব ও অবদান সম্পর্কে তারই সমকালীন ঐতিহাসিক শরিফ উদ্দীন লিখেছেন : ‘বীরত্ব ও দৃঢ় সংকল্প তাকে চীন থেকে গ্রীক সীমান্ত পর্যন্ত সমগ্র এশিয়ার অধিকারী ও দাম্ভিক অহংকারী তাতারিদের সম্রাট বানিয়ে দিয়েছিল। তার কোনো মন্ত্রী ছিল না। তিনি স্বীয় বিশাল সাম্রাজ্যের সকল বোঝা নিজেই বহন করতেন। প্রত্যেকের সাথে তিনি উদার, আন্তরিকতা ও উত্তম আচরণ প্রদর্শণ করতেন। বিদ্রোহী ও নির্দেশ অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতেন। তিনি অত্যন্ত ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। কোনো জালেম-অত্যাচারী তার সাম্রাজ্যে শাস্তি থেকে বাঁচতে পারতনা। তিনি বিদ্যা-শিক্ষানুরাগী ছিলেন এবং আলেমদের কদর করতেন, সম্মান প্রদর্শণ করতেন। তিনি শিল্পকলার উন্নয়নের জন্য চেষ্টা করতেন। যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি উত্তম কাজ করতেন, তিনি সেবাকারিদের প্রতি সর্বদা সদয় থাকতেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন