সূর্যের চারদিকে আরেকবার ঘুরে এসে পৃথিবী ইংরেজি নতুন বছরে পদার্পন করল। যদিও সৃষ্টির পর থেকে সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর এমন অবিরত ঘূর্ণায়মান ছুটে চলার কোনো বিরতি নেই, এমনকি কারও সঠিক জানাও নেই যে, কত কাল ধরে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে এভাবে অবিরাম প্রদক্ষিণ করে বেড়াচ্ছে। তবুও মানুষের যাপিত জীবনকে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুনে আবদ্ধ এবং জীবনের মান উন্নয়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়কে সূচনা হিসেবে ধরে নিতে হয়েছে।
ইংরেজি নববর্ষ উদয় হয় নিঝুম রাতের স্তব্দময় নিকষ অন্ধকারে প্রচÐ শীত ও কুয়াশার চাদর জড়িয়ে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মহা আনন্দ উদ্দপিনায় পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ উৎসব।
একত্রিশ ডিসেম্বর হচ্ছে নিউ ইয়ার ইভ। আধুনিক গ্রেগরিয়ান এবং জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মতে ১ জানুয়ারি শুরু হয় নতুন বছর। অথচ নতুন বছর উদযাপনের বিষয়টি শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দে, অর্থাৎ প্রায় ৪০০০ বছর আগে থেকেই। ওই সময়ের মেসোপটেমিয় সভ্যতার লোকেরা নতুন বছর উদযাপন শুরু করত। ওরা ওদের নিজস্ব গণনা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করতো।
যেসব দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়, তারা সাধারণত নববর্ষ ১ জানুয়ারি পালন করে থাকে। আজকের ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনে যতটা সাড়ম্বরে দিনটিকে পালন করা হয়, একসময় কিন্তু এভাবে পালিত হয়নি।
আমেরিকার মেক্্িরকোতে এক সভ্যতার উদয় হয়েছিল। খিষ্ট্রপূর্ব ৫ম শতাব্দী থেকে এ সভ্যতার বিকাশ অত্যন্ত বিস্ময়কর অবস্থায় পৌঁছেছিল; যার নাম ‘মায়া’ সভ্যতা। হায়ারোগিøফিগ লিপি মায়া সভ্যতার অগণিত বৈচিত্রময় কীর্তি-কাহিনির মধ্যে অন্যতম। ইদানিং ওই দুর্বোধ্য হায়ারোগিøফিগ লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছে। যার ফলে মায়াদের সম্পর্কে বহু অজানা নতুন তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। ওদের সংখ্যাতত্তে¡র সম্যক জ্ঞান, স্থাপত্য-শিল্পকলার বহুবিধ বিস্ময় এমনকি গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের অনন্য অসাধারণ দক্ষতা হতবাক করে দিয়েছে। এমনকি মায়ারাই আবিষ্কার করেছিলÑ পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন। তারা এই সময়কালকে ১৮ মাসে ভাগ করে প্রতিমাসের দিন-সংখ্যা নির্ধারণ করেন ২০। আরও বলা হয়ে থাকেÑ খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ সাল পর্যন্ত যে ক্যালেন্ডারের উদ্ভাবন হয়েছিল সেখানে দিন-সংখ্যা ছিল ৩০০। ৩০০ দিনকে ১০ ভাগে ভাগ করে মাসের দিন-সংখ্যা করা হয়েছিল ৩০; যা আজকের মাসের গড়দিন; একে রোমুলাস ক্যালেন্ডার বলা হয়ে থাকে। এই রোমান ক্যালেন্ডারে প্রথম শুরুর মাস ছিল রোমানদের যুদ্ধদেবতার নাম অনুসারে ‘মারটিয়াস’, বর্তমান সময়ের মার্চ মাস। সুতরাং মার্চে প্রথম দিনটি ছিল বছরের প্রথম দিন। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে জুলিয়াস সিজার এই ক্যালেন্ডারের কিছুটা সংশোধন করেছিলেন। ওই সময়ের বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ এ বিষয়ে তাকে বেশ সাহায্যও করেছিলেন। এই ক্যালেন্ডারে সূর্যকে প্রদক্ষিণের সময় নির্ধারিত হয় ৩৬৫ দিন। কিন্তু ৩৬৫ দিনে এক বছর রেখে অতিরিক্ত ১ দিন প্রতি চার বছর অন্তর ফেব্রæয়ারি মাসের সঙ্গে যোগ করা হয়। তখন ফেব্রæয়ারি মাসের দিন-সংখ্যা দাঁড়ায় ২৮ থেকে ২৯ দিন; এই বাড়তি দিনকে ‘লিপ’-ডে এবং ওই বছরকে বলা হয় ‘লিপিয়ার’। এই ক্যালেন্ডারটিই ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ নামে পরিচিত ছিল। বহু বছর এ ক্যালেন্ডার চালু ছিল।
জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। জানুস হলেন প্রবেশের পথ বা সূচনার দেবতা। এই জানুস দেবতার নামানুসারেই জানুয়ারি মাসের নামকরণ করা হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৪৭ সালে মার্ক অ্যান্টোনির কনসুলের এক দফা পরিবর্তনের পর খ্রিস্টপূর্ব ৮ সালে এম্পরর অপাসটাস সিজার এই ক্যালেন্ডারে আরেক দফা পরিবর্তন করেন।
এরপর যিশুখ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে সর্বশেষ ১৫৮২ সালে মতান্তরে ১৫৭৭ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি এই ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন; যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। যা পরবর্তীতে বিশ্বের বহু দেশের সিভিল ক্যালেন্ডার হিসেবে গ্রহণ করে। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নতুন বছরের শুরু হয় ১ জানুয়ারি এবং তারিখ লেখার শেষে যে এডি (অ.উ) লেখা হয়, তা লাতিন অ্যানো ডোমিনি(অহহড় উড়সরহর) এর সংক্ষিপ্ত রূপ। অ্যানো ডোমিনির অর্থ হলোÑ আমাদের প্রভূর বছর ( ওহ ঃযব ুবধৎ ড়ভ ড়ঁৎ খড়ৎফ) অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারটি গ্রহণের পূর্বেই নববর্ষ পালনের রীতি পালিত হলেও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস জানুয়ারি হিসেবে ১ জানুয়ারি নববর্ষ রীতি পালন করা শুরু হয়। বিভিন্ন সূত্রমতেÑ আধুনিক বিশ্বে জানুয়ারির প্রথম দিনটিকে নববর্ষ হিসেবে প্রচলিত করার ক্ষেত্রে ‘রিপাবলিক অব ভেনিস’(১৭৯৭ সালে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ, তারাই ১৫২২ সাল হতে এ দিনটিকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে পালন করতে আরম্ভ করে। পর্যায়ক্রমে স্পেনÑ ১৫৫৬ সাল হতে, সুইডেনÑ ১৫৫৯ সাল হতে, ফ্রান্সÑ ১৫৬৪ সাল হতে, স্কটল্যান্ডÑ ১৬০০ সাল থেকে, রাশিয়াÑ ১৭০০ সাল থেকে এবং ১৭৫২ সাল থেকে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটিশ অঙ্গরাজ্য ও কলোনিসমূহ নববর্ষ রীতি পালন শুরু করে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ইংরেজি নতুন বছর পালন শুরু হয় উনিশ শতকের শুরু থেকেই; তবে এর আগেই রোমে নতুন বছর পালন শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩ সালে। ঐতিহাসিকভাবে রোমান ক্যালেন্ডারে নতুন বছর শুরু হতো ১ মার্চ থেকে।
কিন্তু একসময় মধ্যযুগীয় ইউরোপে চার্চ কর্তৃক জানুয়ারি ১ তারিখকে প্যাগানীয় ও অখ্রিস্টান কালচার বলে প্রচার করে; যার ফলে ঈড়ঁহংরষ ড়ভ ঞড়ঁৎং কর্তৃক ৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি ১ তারিখকে বছরের প্রথম দিন হিসেবে বাতিল করা হয়। ওই সময়ে খ্রিস্টান অধ্যুষিত ইউরোপে যীশুখ্রিস্টের জন্মদিন ২৫ ডিসেম্বর কিংবা মার্চের ১ তারিখ এমনকি ২৫ মার্চ বা ইস্টার সানডের দিনকেই বছরের প্রথম দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল।
খ্রিস্টাব্দের হিসাব অনুসারে ১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের ১ তারিখই যীশুখ্রিস্টের জন্ম বলে আমরা যে ধারণা পোষণ করে আসছি, এর সত্যতা ভিত্তিহীন। যেমনÑ বাইবেলের নতুন নিয়মে বর্ণনা(মথি ২.১) থেকে জানতে পারি যে, হেরোদ রাজার শাসনামলে পূর্বদেশ থেকে কয়েকজন পÐিত নক্ষত্র দেখে যীশুকে দেখতে এসেছিলেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে যে, যীশুর জন্মের সময় আকাশে কোনো নতুন নক্ষত্রের উদ্ভব হয়েছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে আকাশে এরূপ নক্ষত্র সংযোগ ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৭ অব্দের ১৫ সেপ্টেম্বরে। যদি হ্যালির ধূমকেতুকে ওই সংযোগে ধরা হয়, তাহলে তা খ্রিস্টপূর্ব ১২ অব্দে। তাহলে সেই হিসাবে যীশুর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৭-১২ অব্দের মধ্যে। বাইবেলে আরও বহু জায়গায় যীশুর জন্ম সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়; যেমন- মথি ১৩-১৭ অনুযায়ী যিশু খ্রিস্টের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৪ অব্দের দিকে।
লুক ২.১-৭ থেকে জানা যায়Ñ যিশুর জন্ম ৬-৭ খ্রিস্টাব্দের ভেতরে। লুক ৩-২৩ অনুযায়ী যীশুর জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫-৪ অব্দে।
আন্তর্জাতিক সাল হিসেবে খ্রিস্টাব্দ সারা বিশ্বে স্বীকৃত; যার সাথে জড়িয়ে আছেন খ্রিস্টধর্মপ্রবর্তক ঈসা মসীহ। যাকে ইংরেজিতে ঔবংঁং ঈযৎরংঃ বলা হয়। বাংলা খ্রিস্টাব্দ(খ্রিস্ট+অব্দ) শব্দটি এসেছেÑ ইংরেজি ‘ঈযৎরংঃ’ এর সাথে সংস্কৃত ‘অব্দ’ শব্দের স্বরসন্ধির মাধ্যমে। সাধারণভাবে খ্রিস্টাব্দ কে যীশুর জন্মদিবস থেকে গণনা করা হলেও ঐতিহাসিকভাবে এবং বাইবেলর তথ্যানুযায়ী যীশু যে ১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তা সত্য নয়। কিন্তু খ্রিস্টাব্দ মূলত যিশু খ্রিস্টের স্মরণে প্রবর্তিত একটি সাংকেতিক সাল।
ডাইওনিসিয়াম একমিগুয়াম নামের এক খ্রিস্টান পাদ্রি জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৩২ অব্দে যিশু খ্রিষ্টের জন্ম বছর থেকে হিসাব করে এই খ্রিস্টাব্দ লেখার রীতিটি চালু করেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়।
ইংরেজি নববর্ষ পালনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট ব্যতিক্রমও লক্ষ করা যায়। ইসরায়েল গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও নববর্ষ পালন করে না। এক্ষেত্রে ধর্মীয় বিভেদের কারণে অ-ইহুদি উৎস থেকে উৎপন্ন এই রীতি পালনে বিরোধিতা করে থাকে। এছাড়া বিশ্বের বহু দেশ রয়েছে যারা কিনা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণই করে না। যেমনÑ সৌদি আরব, আফগানিস্তান, ইরান, ইথিওপিয়া ও নেপাল। এসকল দেশে ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।
বিশ্বেও বহু দেশে বছরের প্রথম দিনটি সরকারি ছুটির দিন। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২ টা থেকে শুরু হয় নতুন বছর উদযাপনের উন্মাদনা। আকাশে ছড়িয়ে পড়ে আতশবাজির আলোকছটা। হেপি নিউ ইয়ার... হেপি নিউ ইয়ার.. ধ্বনিতে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে থাকে। বিশ্বব্যাপী নিউ ইয়ার ডে রূপান্তরিত হয় সার্বজনীন উৎসবে।
আমাদের দেশে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্রিটিশ বেনিয়া ইস্ট ইন্ডিয়ান কোম্পানি আমাদের স্বাধীনতা হরণ করে আমার ওপর চাপিয়ে দেয়। অথচ সেই ব্রিটিশরা এই ক্যালেন্ডার তাদের দেশ গ্রেট ব্রিট্রেনে চালু করে ১৭৫১ সালে।
আমাদের দেশের নববর্ষ বৈশাখের প্রথম দিন। অত্যন্ত আনন্দ উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে আমরা বাংলা নববর্ষ পালন করে থাকি। মূলত বাঙলা নববর্ষ বাঙলা সস্কৃতির একটি প্রধান অঙ্গ। তবুও আমাদের দেশেও রাজধানীসহ বিভিন্ন শহওে আতশবাজীর আলোকলীলার মধ্যদিয়ে ‘হেপি নিউ ইয়ার’ শব্দ উচ্চারণ করে ইংরেজি নববর্ষকে স্বাগত জানানোর উৎসব উদযাপন করে থাকি। এ রীতি বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ছে।
নতুন বছরটি সকল জাতি ও মানুষের জন্য হয়ে উঠুকÑ আলোকিত নতুন পথে পদযাত্রার উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন