‘বৎস! আমার আশা , তুমি সর্বদা আল্লাহর নির্দেশাবলী ও মোহাম্মদী শরিয়তের অনুসরণ করে চলবে, সৈয়দ বংশ ও দরবেশদের দোয়া লাভ করবে এবং দ্বীনের ফরজগুলো আদায় করতে থাকবে’। আমির তৈমুর লংয়ের শৈশবের কথা।
এ সময় মাতৃহারা তৈমুরের ভাই-বোন কেউ ছিল না। তার পিতা তবগাই ছিলেন সূফীমনস্ক সংসার ত্যাগী। পুত্রের ভবিষ্যত সম্পর্কে তার কোনো চিন্তা ভাবনা ছিল না এবং চাচা হাজী বরলাসও ছিলেন উদাসীন। তুর্ক তাতারি বংশের বারলাস গোত্রের চলার পথে শুধুই ছিল অন্তরায় ও প্রতিবন্ধকার প্রাচীর। তার চলার পথে বড় উৎসাহ ও প্রেরণার মূলমন্ত্র ছিল তার দুনিয়া ত্যাগী পিতার বর্ণিত মূল্যবান সংক্ষিপ্ত উপদেশ।
চেঙ্গীজ খান ছিলেন তৈমুরের নানা। চেঙ্গীজ খানী তেজ তার মধ্যে বহমান ছিল। তৈমুর সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে একাধিক প্রত্যক্ষ সংগ্রামে বিজয় লাভ করেছিলেন। এ জন্য তাকে প্রতিপক্ষ মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেছিল। ঘটনাটি ছিল এই যে, একবার মোগল খানের লোকেরা সমরকন্দের কতিপয় মেয়েকে দাসী বানিয়ে ‘হেসারুল মালিক’ নামক স্থানে নিয়ে যাচ্ছিল, যাদের মধ্যে কিছু সৈয়দ বংশীয় মেয়েও ছিল। তখনও মোগলরা ইসলাম গ্রহণ করেনি।
এ অপহরণকারীদের অসৎ উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বিদ্বেষ এবং সৈয়দ- জাদীদেরকে দাসী হিসেবে প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মানহানি করা। তৈমুর এ খবর পেয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং ধৈর্য্যচ্যুত হয়ে বের হয়ে পড়েন এবং কয়েদি মহিলাদের তরবারির জোরে দুর্বৃত্তদের কবল হতে মুক্ত করেন। তার এ দুঃসাহসিক ভ‚মিকায় ঈর্ষান্বিত ও ক্ষুব্ধ মোগল খান কর্তৃক তৈমুরের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা হয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, ব্যক্তি জীবনে তৈমুর লং ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, নামাজি এমনকি শরয়ি কারণ ব্যতীত তার কোনো নামাজই কাযা হতো না এবং কোরআন শরীফ সর্বদা তার সঙ্গে থাকত। সফরকালে এবং রণাঙ্গণেও সর্বদা তার সঙ্গে থাকত সফরি জায়নামাজ এবং নিয়মিত নামাজ পড়তেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ এবং ধর্মবিদ আলেম-উলামা ও পীর আওলিয়াভক্ত এবং আলেমদের ধর্মীয় আলোচনা-বিতর্ককে পছন্দ করতেন এবং তাদের প্রতি যথাযথ ভক্তি সম্মান প্রদর্শণ এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করতেন।
তিনি যখন সমরকন্দকে তার রাজধানী করেন তখন আলেম-উলামা ও কবি সাহিত্যিকদেরও এক বিরাট দলকে সেখানে নিয়ে যান এবং অন্যান্যদের ন্যায় তাদেরকেও সেখানে পূণর্বাসিত করেন। নির্মাণ কার্যের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই আগ্রহী। এ পর্যায়ে তিনি শান্দার বহু মসজিদ নির্মাণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধিকরণ এবং স্মরণীয় কবরস্থানগুলোর সৌন্দর্য বর্ধণ করেন। শরিয়ত সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তির জন্য সকল স্থানে কাজি বা বিচারপতি নিয়োগ করেন এবং তাদেরকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে যাবতীয় বিচারকার্য পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন।
তৈমুর প্রাথমিক জীবনে মসজিদে সময় কাটাতেন এবং বসে বসে কোরআন তেলাওয়াত করতেন। একবার তিনি তেলাওয়াত করছিলেন এমন সময় তার প্রতি এক সৈয়দ বুজর্গের দৃষ্টি পড়ে এবং তিনি নিকটে এসে তার নাম জিজ্ঞাসা করেন এবং বলেন, ‘বৎস! যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি ইসলামের হেফাযত করতে থাকবে, আল্লাহতাআলা তোমার হেফাজত করতে থাকবেন।’ তৈমুর জুমার দিন মসজিদে খুতবার সময় মুসল্লিদের জুতার নিকট বসে থেকে জুতা পাহারা দিতেন। সৈয়দ জয়নুদ্দীন নামক এক দরবেশ তাকে এ অবস্থায় স্বীয় শাল, টুপী এবং আংটি উপহার দেন।
পরবর্তীকালে বিখ্যাত পারস্য কবি হাফেজ শিরাজির ঘটনাটি খুবই চমকদার। তার একটি প্রসিদ্ধ কবিতার জন্য তৈমুর লং তাকে তলব করেন এবং কবিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে এবং বিদ্রুপ করে বলেন, ‘তুমি কি জান, সমরকন্দ ও বোখারা আমি কত কষ্টে লাভ করেছি! আর শিরাজের তোমার মতো এক দরিদ্র কবি এতই উদার যে, প্রিয়ার কপালের একটি তিল (আচিল)-এর বিনিময়ে সমরকন্দ ও বোখারা দান করে দিচ্ছ?’ কবি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন, ‘আজ দরিদ্র অবস্থায় হাজির হয়েছি।’ এ কথা শুনে তৈমুর আনন্দিত হন এবং তাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করে বিদায় দেন।
আলেম সমাজ সম্পর্কে তাতারি যুদ্ধবাজদের বক্তব্য ছিল, তারা অন্যদেরকে শাহাদত বরণ ও বীরত্বের দরস দেন, কিন্তু উভয় বিষয় থেকে তারা দূরেই অবস্থান করেন। হিন্দুস্থানের অভিযানে পাগলা হস্তীদের দেখে তৈমুরের সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়, তখন প্রতিক্রিয়া অন্যদের চেয়ে আলেমদের অধিক পরিলক্ষিত হতে থাকে।
তৈমুর এসব কালো বিপদ হতে রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করলেও আলেমদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন সারিতে অবস্থান পছন্দ করেন?’ কিছুক্ষণ নীরবতা পালনের পর একজন আলেম দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে বাদশাহ! আপনি যেখানে নির্দেশ করবেন আমরা সেখানেই অবস্থান করব, তবে ফয়সালা যদি আমাদের ওপর ছেড়ে দেন তা হলে আমরা মহিলাদের নিকট অবস্থান করাটাই অধিক সমীচীন মনে করব।’ তৈমুর হেসে বললেন, ‘আমিও এটাই ভাবছিলাম।’
এক সময় তৈমুরের দরবারে দুই মতবাদের উলামা পরস্পর বাহাস-বিতর্কে লিপ্ত ছিলেন। তৈমুর কোনো ইসলামি দেশ অধিকার করে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। আকস্মিক তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘আমি যে অভিযান হতে প্রত্যাবর্তন করেছি তাতে আমার নিহত সৈন্যদের শহীদ বলা হবে নাকি প্রতিপক্ষের নিহত সৈন্যদের?’ দরবারে নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে।
অবশেষে একজন আলেম দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মহামান্য বাদশাহ! বিষয়টি স্পষ্ট ব্যক্তিস্বার্থে অথবা সুনাম-খ্যাতি লাভের উদ্দেশ্যে যে লড়াই করে সে শহীদ নন এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিহত ব্যক্তিও শহীদ নয়, কেবল সে ব্যক্তিই শহীদ যে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী প্রাণ বিসর্জন দেয়।’ এ কড়া জবাব শুনে তৈমুর জবাবদাতাকে হত্যার পরিবর্তে পুরস্কৃত করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন