ইসলামের সূক্ষাতিসূক্ষ উপলব্ধি ও ঈমানের উচ্চতর সংবেদনশীলতার নামই মারেফত। দৈহিক ইবাদত বন্দেগীর ফলাফল ততটাই সুন্দর হবে যতটা মজবুত হবে মনের অবস্থা। তরীকত পুরোটাই মনের কাজ। বড় এক বুজুর্গকে প্রশ্ন করা হলো, তরীকত কী? জবাবে বললেন, হালাল খাদ্য গ্রহণ এবং হারাম থেকে শতভাগ বেঁচে থাকা। আত্মিক ও মানসিক দিক দিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর স্মরণ, প্রেম ও নানাবিধ ইবাদতে লেগে থাকার নামই মারেফত। প্রশ্ন করা হলো, তরীকত কী? জবাব এল, শুধুই আদব। ভালোবাসার জন্য জীবন দিয়ে দেয়া। প্রেমিকের মতো বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে পার্থিব দুঃখ কষ্ট বরণ করে নেয়া। এমন এক সত্ত¡াকে ভালোবাসা যিনি ছাড়া এ জগতে আর কেউই চিরন্তন অজর অমর অক্ষর নন। কারণ, পৃথিবীর সব প্রেমিকই একটি হাহাকারে ডুবে থাকে, বলে ভালোবাসা যত বড়, জীবন তত বড় কেন নয়। এক জনমের ভালোবাসায় তাদের পরাণ ভরে না।
সময়ের ব্যবধানে প্রেমিক ও প্রেমাষ্পদ দু’জনার অবস্থা, অবস্থান ও ‘ইতিহাস’ যেমন বদলে যেতে বাধ্য, ঠিক তেমনই তাদের ‘জিওগ্রাফি’ও তছনছ হয়ে যায়। চেহারা সূরত রূপ লাবন্য শেষ হয়ে যায়। প্রেমিকের বিচ্ছেদ, ধ্বংস, ক্ষয়, মৃত্যু প্রেমাষ্পদের জন্য হতাশার কারণ। উভয়ের ক্ষেত্রেই এ সত্য অবধারিত। ৬০/৭০ বছরের ব্যবধানে কোথায় চলে যায়, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য্য, লাবন্য, অর্থ, সম্পদ, শক্তি, যৌবন, অনুভ‚তি, প্রেম? রয়ে যায় কেবল হতাশা, অতৃপ্ত বাসনা, হাহাকার আর অনন্ত পিপাসা।
মারেফতে বলা হয়, দুনিয়ার মায়া ও প্রেম হচ্ছে ‘ডামি’। প্রকৃত প্রেমের প্রতিচ্ছায়া মাত্র। এর পেছনে জীবন বিলীন করে দেয়া কঠিন বোকামি। বিশাল ব্যর্থতা। জীবন নষ্ট করা। দুনিয়াদারি হচ্ছে কুফুরির প্রতিচ্ছবি। আখেরাতপন্থী হওয়া সাফল্যের চাবিকাঠি। মন যেন দুনিয়াকে পছন্দ না করে। হৃদয়ে যেন শুধু আল্লাহই থাকেন।
প্রকৃত প্রেমাষ্পদ কেবল তিনিই। অন্তরে যেন কেবল তার ভালোবাসাই জায়গা পায়। আর তাদের ভালোবাসা যারা শুধু আল্লাহকেই ভালোবেসেছিলেন। মুমিনের প্রেম হবে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সা.-এর জন্য। বিশ^ব্যাপী আল্লাহর প্রেমিকদের জন্য। নবী করীম সা.-এ মর্মে দোয়া করতেন, বলতেন, হে আল্লাহ, আমাকে তোমার ভালোবাসা দান করো। আর তোমাকে যে ভালোবাসে তার ভালোবাসা।
এমন আমলের তাওফীক দাও, যা তোমার ভালোবাসার কারণ হয়। এমন পথের পথিক বানাও, যা তুমি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায়, তোমার নৈকট্য এনে দেয়। নবীজি সা. বলতেন, দুনিয়ায় আমার কোনো বন্ধু নেই। বন্ধু আমার আল্লাহ।
বোখারা উপকণ্ঠে যখন আমাদের শাহ আমির কুলাল রহ.-এর কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয় তখন মাগরিবের ওয়াক্ত হয়। দিনটি ছিল মেঘলা। টিপ টিপ বৃষ্টি ঝরছিল। শৈত্যপ্রবাহ আর তুষার পতনের পূর্বাভাস। গাড়ির বহর আমির কুলালের আস্তানায়, পৌঁছার পর সোজা গিয়ে ঢুকলাম মসজিদে।
প্রায় শেষ ওয়াক্তে আসরের জামাত পড়ালেন পীর ভাই আল্লামা সাইয়েদ মোহাম্মাদ তালহা সাহেব নকশবন্দী, আমাদের হযরতের আজাল্লে খলিফা ও মাজায। একই মসজিদে মাগরিব পড়ালেন মাওলানা কারী মুহাম্মাদ তৈয়্যব নকশবন্দী। আমার পীর ভাই এবং পুরনো বন্ধু।
এই কমপ্লেক্স যাকে ঐতিহ্যগত কারণে আস্তানা বলছি। বাংলায় যার অর্থ স্থান বা অবস্থানস্থল। জনারণ্যে একা থাকার যে পদ্ধতি আছে তার পূর্ণ প্রয়োগ করার সুযোগ হয় বোখারা সমরকন্দে। তরীকত পরিভাষায় যাকে বলা হয়, খালওয়াত দার আনজুমান। আর অন্তরে বিদ্যমান ছিল, ইমাম মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন নকশবন্দীর দীর্ঘ সাধনার ফসল ওকুফে কালবীর হাল।
অর্থাৎ, দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অন্তরে আল্লাহকে ধরে রাখা আর মানসিকভাবে তার সকাশে সার্বক্ষনিক অবস্থান করা। জীবনের প্রতিটি নিঃশ^াস মহান আল্লাহর স্মরণে, তার সামনে উপস্থিত থেকে, তার দৃষ্টির সম্মুখে ফেলার মধুময় অনুভব। ঐশী আনন্দের অনন্তে সমুদ্রে অহর্নিশি সাবলীল সন্তরণ। সুমিষ্ট অবগাহন। সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা মহান ক্ষমাশীল পরম করুণাময়ের রহমতের অপার সাগরে দিনমান প্রেমময় নিমজ্জন। ওকুফে কালবী মানে ঐশী আনন্দের অনন্তধারা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন