দেখলাম বিশাল কমপ্লেক্সটি আজও কমপ্লিট হয়নি। সীমানা প্রাচীর হয়েছে। হয়েছে প্রধান ফটক। মহিলা ও পুরুষ অজুখানার কাজ চলছে। মসজিদটি নতুন করে সংস্কার হচ্ছে। বাগান, ফোয়ারা, চৌবাচ্চা, ফুলের বেড উন্নয়ন চলছে। অন্ধকার আকাশ খুব ভারাক্রান্ত।
জার্মানী, ফ্রান্স, সিরিয়া, মিশর, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ওয়ালাদের কেউ কেউ ভিডিও করছে। ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ ও চীনের লোকজন চারপাশটা ঘুরে দেখছেন। অনেকেই সাইয়েদ আমির কুলাল রহ. এর কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে বেশ দূরে আস্তানার উত্তর-পশ্চিম কোণে চলে গেছেন।
আমি সমাধি সৌধের ডানপাশে ছাউনির নিচে বেঞ্চিতে বসে চারজন চেচেন পর্যটকের সাথে কথা বলছিলাম। তারা বিদায় হয়ে গেলে আমিও জিয়ারত করতে কবরগাহের কুঠুরি ঘরে ঢুকলাম। সুন্নত মোতাবেক জিয়ারত সেরে পাশের আসনে বসে ঝিমুতে লাগলাম। লাগাতার সফরের ক্লান্তির পাশাপাশি মোরাকাবাতুল কুবুরের ইচ্ছা থেকেও আমার চোখে প্রশান্তির তন্দ্রা চলে এলো। আমি জড়সড় হয়ে বসে রইলাম। মনের পর্দায় ভেসে উঠল ইতিহাসের সে দিনটির দৃশ্য।
প্রায় সাতশ’ বছর আগে আজকের এ রাতটির মত এক রাতেই পীরের হুকুমে বহু দেশ ঘুরে সাধনার চূড়ান্ত পর্যায়ে ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (জন্ম ৭১৮ হিজরী, মৃত্যু ৭৯১ হিজরী) জীর্ণ মলিন পোষাকে শীর্ণ বদনে চরম শীতার্ত হয়ে তুষারপাতের ভেতর এখানে এসে পৌঁছেছিলেন সাইয়েদ আমির কুলালের আস্তানায়। মূল শায়েখ বাবা শামাছি রহ. তাকে যার হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
যিনি তার অন্যতম শায়েখ ওসতাদ ও মুরব্বী। কিন্তু প্রেম ও আনুগত্যের শেষ পরীক্ষাটি তখনও বাকি থাকায় আমির কুলাল ঘর ভর্তি দরবেশদের সামনে হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দকে স্বাগত জানাতে অস্বীকার করে সাথীদের বলেন, একে বের করে দাও। দরবেশরা তাই করেন। নিগৃহীত হয়ে আত্মাভিমানে বাহাউদ্দীন নকশবন্দের বুক ফেটে যায়। পারলে তিনি চিৎকার করে কেঁদে ফেলেন অবস্থা। অপমান ও লাঞ্ছনার তিক্ততা সহ্যের পর্যায়ে ছিল না।
কিন্তু তিনি তো নিজেকে বিলুপ্ত করার দীক্ষাই নিয়েছেন। শায়েখকে ছেড়ে যাবেন না তিনি। রাতভর বাইরে পড়ে রইলেন। প্রচন্ড শীতে, তুষারের হিমেল মৃত্যুবৎ স্পর্শে। ক্ষুধা তৃষ্ণা ও ক্লান্তির চরম সীমায়ও ভালোবাসার বারান্দায় দাঁত কামড়ে পড়ে রইলেন। ধ্যান মোরাকাবায় কেটে গেলো রাতের কয়েক প্রহর।
তাহাজ্জুদের সময় সাইয়েদ আমির কুলাল ঘর থেকে বের হয়ে এসে দেখলেন, নকশন্দ তো রেগে মেগে চলে যান নি। কাছে গিয়ে টেনে তুললেন শাগরেদকে। গরম কামরায় নিয়ে গেলেন। গরম পানিতে গা হাত পা ধুয়ে দিলেন। জঙ্গলাকীর্ণ দীর্ঘ পথ চলায় পায়ে বিঁধে থাকা কাঁটা নিজে বের করে ক্ষতস্থানগুলো পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার বাহাউদ্দীন কামেল পুরুষ হতে পেরেছে। হে সৌভাগ্যবান সন্তান, সাফল্যের পোষাক তোমার মতো সৌভাগ্যবানের অঙ্গেই শোভা পায়। অত্যন্ত মহব্বত ও ¯েœহপূর্ণ বাক্যালাপ করে ইমাম বাহাউদ্দীন নকশবন্দের দীর্ঘ সাধনার সব কষ্ট ভুলিয়ে দিলেন।
নভেম্বর ২০১৯ এর এক শীতের সন্ধ্যায় ঠিক সে জায়গাটিতে বসে ইতিহাসের টাইম মেশিনে চড়ে আমি ঘুরে এলাম ৭০০ বছরের বহু অলি গলি, বহু বর্ণিল পথ। ভাবতে আমার এতই ভালো লাগছিল যে, ১২০০ বছর আগেকার খাজেগান ঘরানার উত্থান ও বিকাশ পর্যন্ত কল্পনার চোখে দেখে এলাম। ১৪০০ বছরকার সিদ্দিকিয়া সিলসিলা পর্যন্ত নজর বুলানো শেষ। এরই মধ্যে অন্য অনেক জিয়ারতকারী এসে গেছেন মাজারের পাশে।
দীর্ঘ পথ হেঁটে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, জার্মানী, ফ্রান্স, সউদী আরব ও বাংলাদেশের নারী পর্যটকদের দলটিও সমাধি সৌধের পাশের বেঞ্চিতে বসে ইতোমধ্যেই দোয়া মুনাজাতে নিমগ্ন হয়েছেন। লোকজনের উপস্থিতি আমার একাকীত্ব ভেঙ্গে দেয়ায় আমি প্রশান্তির কল্পনা ছেড়ে, সমাধি থেকে মসজিদে যাওয়ার রাস্তায় পদচারণা শুরু করলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন