শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

মেলায় দৃষ্টিহীনদের চোখে আলো!

নুর হোসেন ইমন | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ১২:০২ এএম

মানুষ দৃষ্টিহীন বলে অন্ধ নয়, বরং মানুষ প্রজ্ঞাহীন হলেই অন্ধ হয়। কারণ সমাজের বাহ্যিক দৃষ্টিতে চোখে দৃষ্টি না থাকা মানুষগুলো বারবার প্রমাণ করেছেন সুযোগ পেলেই তারা নিজেরা আলোকিত হওয়ার পাশাপাশি সমাজকে আলোকিত করতে পারেন। তাই আজকাল শারিরীক প্রতিবন্ধকতার শিকার জনগোষ্ঠীকে ‘ভিন্নভাবে সক্ষম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সমাজের এসব মানুষ প্রতিবন্ধী নয় বরং পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারায় এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে প্রতিবন্ধী বললে অত্যুক্তি হবে না।

দৃষ্টিহীন মানুষদের মন সদা জাগ্রত, আলোকিত। সমাজের এ অংশের বইপ্রেমিদের কথা চিন্তা করে প্রতি বছরের মত এবারও অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাংলা একাডেমি অংশে স্টল বসিয়েছে ব্রেইল প্রকাশনী। এ উদ্যোগের ফলে পাঠ্যানুরাগী দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে পাচ্ছে খ্যাতিমান লেখকের লেখা কবিতা, উপন্যাস, ইতিহাস ও গল্পের বই পড়ার। গতকাল শনিবার মেলাপ্রঙ্গণ সরজমিনে ঘুরে দেখা যায় বাংলা একডেমি প্রাঙ্গণে ব্রেইল প্রকাশনীতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের বই পড়ার চমৎকার দৃশ্য। একাডেমি অংশে মেলা থেকে বের হওয়ার পথে হাতের ডান পাশে আলো ছড়াচ্ছে স্টলটি।

চোখে আলো না থাকলেও সব বাধা পেরিয়ে এখানে এখানে দৃষ্টিজয়ীরা আলোর পথযাত্রী। ব্রেইল পদ্ধতিতে পাতাজুড়ে ছয়টি করে বিন্দুর বিভিন্ন সংকেত থাকে। ঘর আকৃতির সংকেতগুলোতে হাত বুলিয়েই প্রাণের আলো মেলে ধরতে পারেন তারা। এর মাধ্যমেই সমাজ, রাষ্ট্র, শিল্প-সাহিত্যের সব খবর মিলছে। ফুটায় ফুটায় স্পর্শ করেই দৃষ্টিজয়ীরা অনর্গল পড়ে যাচ্ছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। আর তা মুগ্ধচিত্তে দেখছেন মেলায় আসা দর্শনার্থীরা। পুরো গ্রন্থমেলার চারদিকে যখন নতুন বইয়ের ঘ্রাণ, তখন তারাও ব্রেইল পদ্ধতির বই পেয়ে খুশি।

ব্রেইল প্রকাশনীর স্টলে কথা হয় দৃষ্টিজয়ী শিক্ষার্থী নাজীমের সাথে। গাজীপুরের একটি স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র সে। পড়ছেন আশিক মুস্তাফা রচিত, ১৯৭১ বিচ্ছু বাহিনী বইটি। ইনকিলাবের সাথে স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আমরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে সব ধরনের লেখকের বই নিজেরা পড়তে পারি না। অন্যের মুখে বিভিন্ন লেখকের গল্প শুনি। নিজে নিজে বই পড়ার মজাই তো আলাদা! যেসব বই ব্রেইল আকারে প্রকাশ করে সেগুলোই নিজে পড়তে পারি। তিনি দাবি জানিয়ে বলেন, যারা ভালো বই লিখেন তারা যদি আমাদের কথা চিন্তা করে ব্রেইল আকারে বই প্রকাশ করেন, তাহলে আমাদেরও নতুন বই পড়ার স্বাদ মিটতো।

ব্্েরইল প্রকাশনার নতুন বইয়ের মধ্যে এবার এসেছে, টুনির গল্প, কত কাল ধরে, কাক তাড়–য়া, ঢাকার কথা, আমার মা সবচেয়ে ভালো, বনভোজন, গহিন অরণ্যের ডাক্তার, ইঁদুর ছানার গল্প। মেলার সময় বাড়তে বাড়তে আরও নতুন বই আসতে পারে বলে জানানো হয়েছে। এ প্রকাশনীর সাথে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বই প্রকাশ করার পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরী করতে কাজ করছেন তারা। স্টলে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন দৃষ্টি-প্রতিবন্ধী বই পড়ছেন।

স্টলে দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের বই দিয়ে সহযোগীতা করতে দেখা যায় লীয়া নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ইডেন মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। নিজে সুস্থ হলেও সমাজের ভিন্নভাবে সক্ষম মানুষদের জন্য কাজ করে আনন্দ পান বলে জানালেন লীয়া। তিনি বলেন, দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের আলোকিত করতে স্পর্শ ব্রেইল প্রকাশনা এগিয়ে এসেছে। তারা এ পর্যন্ত ৮১টি ব্রেইল পদ্ধতির বই প্রকাশ করেছে। তবে তাদের একার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব নয়। এ প্রকাশনীর মতো দেশে যেসব সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা আছে তারা যদি ব্রেইল বই প্রকাশে এগিয়ে আসে তাদের দৃষ্টিহীনদেন সত্যিকার অর্থে আলোকিত করা সম্ভব। তিনি আরও বলেন, সমাজের ভিন্নভাবে সক্ষম এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই একটি অন্তভূক্তিমূলক সমাজ গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রতিটি প্রকাশনী থেকে ব্রেইল বের করার বাধ্যবাধকতা আরোপের কথা বলছেন দৃষ্টিজয়ীরা। তারা বলছেন, ব্রেইল পদ্ধতিতে বই বের করা অনেক ব্যয়বহুল। ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ব্রেইল বই নিয়ে যান এবং পড়া শেষ হলে পুনরায় তা ফেরত দেন। তাই ব্রেইল বইয়ের আরও স্টল থাকা দরকার। পাশাপাশি বাংলা একাডেমিকেও ব্রেইল বই বের করতে হবে। প্রত্যেক প্রকাশনী থেকে প্রতিবছর একটি হলেও ব্রেইল বই বের করার দাবি জানিয়েছেন তারা। প্রসঙ্গত, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা দানের জন্য লুই ব্রেইল নামে এক ফরাসি একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি আবিষ্কার করেন যাকে ব্রেইল পদ্ধতি বলা হয়। এতে ছয়টি উঁচু বিন্দুকে বিভিন্নভাবে সাজিয়ে অক্ষর, সংখ্যা প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়। একটি বিশেষ ছিদ্রযুক্ত ধাতব পাত অথবা টাইপরাইটার ব্যবহার করে ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা যায়। এটা আঙুলের স্পর্শ অনুভূতি ব্যবহার করে পড়তে হয়।

গ্রন্থমেলার ৭ম দিনে গতকাল শনিবার মেলায় ছিলো শিশুপ্রহর। শিশুদের জন্য সকাল ১১টা থেকে মেলা প্রন্তর খুলে দেয়া হয়। বেলা ১টা পর্যন্ত থাকে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত সময়। এসময়ে শিশুদের নিজেদের মতো করে অবাধে ঘুরেফিরে আনন্দ করতে ও বই কিনতে দেখা যায়। সকাল ১১টার আগেই প্রবেশ পথে দীর্ঘ লাইন পড়ে যায় তাদের। শিশুপ্রহরে অভিভাবকের সাথে আসা কচি কাচাদের সিসিমপুর নিয়েই মেতে থাকতে দেখা যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন