অনেক বড় কমপ্লেক্স। ধারণার চেয়েও বড়। মনে হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত যেতে আধা কিলোমিটারের মতোই হাঁটতে হয় কি না। দু’পাশে ক্ষেত না বন তাও ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না। কুয়াশার কারণে দু’য়েক হাতের বেশি দেখা যায় না।
আমি সারাটা পথ একা কী করে যাব, এ নিয়ে সামান্য ভাবতেই শুরু করেছিলাম মাত্র। এর মধ্যেই দশ-বারো জনের একটি দল পেছন থেকে খুব দ্রুতগতিতে আমাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমি নিজের গতিতেই দলটির পিছু পিছু চলতে লাগলাম। মনে তখন কোনো অস্বস্তি বাকি রইল না। রাস্তার শেষের দিকে দেখলাম, পথ দু’ভাগ হয়ে গেছে। ওখানেও বসার বেঞ্চি। একটু বেশি সংখ্যক লাইট পোস্ট। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে বুঝলাম, আমি ঠিক জায়গায়ই এসে পড়েছি। আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়ে একটি প্রাচীন মসজিদ দেখতে পেলাম। জায়গাটি তো হাজার বছরের পুরনো।
বাহাউদ্দীন নকশেবন্দ ৭১২ হিজরির লোক। তাঁর মা নিশ্চয় আরো আগের। নির্মিত মসজিদটিও ৫-৬শ’ বছরের হবে। দেখলাম, মক্কা শরীফের এক দর্শনার্থী তাঁর বিবি বাচ্চা নিয়ে এখনও এখানে আছেন। সিরিয়ার কয়েক জন পরিচিত শায়খ জিয়ারত করছেন। প্রচুর ভারত পাকিস্তানি লোকজনও রয়েছেন। মসজিদের পশ্চিম লাগোয়া মোটা প্রাচীর ঘেরা কবরস্থান। বড় খিলানের মতো জায়গায় জালির সিরামিক লাগানো। বিদেশি মেহমানরা জিয়ারত করছেন।
আমি কবরস্থান পার হয়ে মসজিদের অপর পাশে গেলাম। দেখি, বিশাল এক চত্বর। ওপাশে কবরস্থানের গেইট। স্থানীয় এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইলাম, ভিতরে এতগুলো কবরের মধ্যে বিবি আরিফার কবর কোনটি। লোকটি ইশারায় দেখিয়ে দিলো। ৪-৫টি চিহ্ন দেয়া কবর। মাথার দিকে উঁচু দেয়াল। কয়েক কদম সামনে গিয়ে একটি উঁচু বারান্দায় উঠলাম।
শীতে তখন শরীর প্রায় আড়ষ্ট। উল্টো দিকে মসজিদের দরজা। মসজিদে কিছু সময় কাটাব বলে প্রবেশ করেই বিস্মিত হয়ে গেলাম। প্রাচীন আমলের মসজিদটি সম্পূর্ণ গরম। অথচ ভেতরে কোনো হিটার কিংবা গরমের ব্যবস্থা দেখছি না। এটি শত শত বছর আগে শীতের এলাকায় ভবনের ভ‚গর্ভস্থিত হিটিং সিস্টেমের ফল। লাকড়ি জমা করে মসজিদটির তেহখানায় সিটি কর্পোরেশনের কর্মীরা নিয়মিত মসজিদটি উষ্ণ করে রাখে। প্রাকৃতিক এ নিয়মের শৈত্য মোকাবেলায় প্রাকৃতির ব্যবস্থার এ সুখানুভ‚তি মনে রাখার মতো।
মেহরাবের কাছে মাগরিবের পরের কিছু নামাজ পড়ছি আর শান্তি অনুভব করছি। নামাজের ফাঁকে বাইরের কিছু দর্শনার্থীকে ডেকে বললাম, যাদের বেশি শীত করছে তারা কিছু সময় মসজিদে এসে কাটান। কয়েক জন এসে সত্যিই আনন্দিত হলেন। একজন বললেন, এশার ওয়াক্ত হয়ে গিয়েছে আমরা জামাতে নামাজ পড়ে ফেলি। আমরা তাই করলাম। মসজিদের চার দিককার দেয়ালের উপরিভাগে অনেকগুলো ফার্সি পঙ্ক্তি খোদাই করা আছে।
আমি কবিতাগুলো পড়েছি। কিন্তু এগুলো নোট করে আনার সময় সুযোগ পাইনি। নামাজ শেষে মসজিদে বসেই মুর্দেগানের জন্য দুআ করলাম। সামান্য সময় মুরাকাবা করে এজন্য বের হয়ে এলাম যে, আর দেরি করলে কমপ্লেক্সের বাইরে অপেক্ষমান গাইড ও ড্রাইভার বিরক্ত হয়ে যাবে। আর এখানকার দর্শনার্থীরাও চলে যাবেন। এত কুয়াশায় এশার পর এতটুকু পথ একা একা ফিরে যেতেও আমার অস্বস্তি লাগবে।
একদম জনমানবহীন এলাকাটি আমাদের মতো ভিনদেশি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ অচেনা। আবার এত দূর পথ হেঁটে ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। বললাম, তারা যদি আর আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে সম্মত হয় তা হলে পুরো কমপ্লেক্স না ঘুরে শুধু গেইটের কাছে ইমাম মুহাম্মদ বাহাউদ্দীন নকশেবন্দের কবরটি একটু জিয়ারত করে যাই। অল্প সময়ে তাই হলো। এ অল্প সময়টিও অবচেতনে হয়ে গেল ঘণ্টাদেড়েক।
বিশাল কমপ্লেক্স, গেইট পেরিয়ে ডানে দীর্ঘ মাদরাসা ভবন, মাঝে মিউজিয়াম, বাম পাশে দরবেশদের স্মৃতিমন্ডিত বহু কক্ষ, বড় দুই মসজিদ, চত্বর, মিনার, চবুত্রা, কবর, ইত্যাদি এক নজর ঘুরে দেখে মুগ্ধ হই। আসলে কিছুই দেখিনি। আলো আধারির ঘেরাটোপে আর শীতের কুয়াশা ঢাকা বাতাবরণে শুধু অনুভব করেছি ৭০০ বছরের জমে থাকা আলো আর সুবাস। এভাবেই অল্প সময় পার হয়ে যায়।
কি কি দেখেছি তার সামান্য বর্ণনা আরেকবার দেবো। দিনের বেলা যখন এসেছিলাম, তখনকার আলোচনায়ও বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। তবে, জীবনের কিছু কিছু রাত হারামাইনে, মিশর, তুরস্কে, মধ্য এশিয়ায়, দূরপ্রাচ্যে, উপমহাদেশ ও মাতৃভ‚মি বাংলাদেশে এমন কেটেছে, যেগুলো ভোলার নয়। যে অনুভ‚তি লিখে বা বলে প্রকাশের নয়। কবি বলেছেন, ‘হাজার সুবহে জামিল ইসপে নেছার/ওহ এক রাত, জো কাটি খোদা খোদা কারকে।’
অর্থাৎ, আল্লাহর প্রেমসান্নিধ্যে, তার স্মরণ ও গুণগানে আর নিমগ্ন ধ্যানে কেটে যাওয়া একটি রাতের প্রহর এতই দামী ও সুন্দর যে, শত সহস্র নতুন ও সুন্দর ভোর-এর জন্য জীবন দিতে পারে। মানুষ যত সুন্দরের সাথে পরিচিত এর সব কোরবান হতে পারে একটি প্রেমময় প্রহরের জন্য। এরপর অন্য একটি ফটক দিয়ে আমরা বের হয়ে গাড়িতে পৌঁছি। মনে অনেক তৃপ্তি ও চোখে অনেক শান্তিময় দৃশ্য এঁকে নিয়ে হোটেলে ফিরে যাই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন