রক্তচাপ যদি স্বাভাবিকের চাইতে বেশি থাকে তাহলে তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। সাধারনত স্বাভাবিক রক্তচাপ হলো ১২০/৮০ মি.মি. পারদ চাপ। যেখানে ১২০ কে সিস্টোলিক (হৃদ-সংকোচন) এবং ৮০ কে ডায়াস্টোলিক (হৃদ-প্রসারণ) চাপ বলা হয়। অর্থাৎ রক্তচাপ যখন ১৪০/৯০ মি.মি. পারদ চাপের বেশি হবে তখন সেই অবস্থাকে আমরা উচ্চ রক্তচাপ বলবো। বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনকে অনেক সময় শুধু “প্রেশার” বলেও উল্লেখ করা হয়।
উচ্চ রক্তচাপের শ্রেনীবিভাগ
উৎস: আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (২০০৩)
উচ্চরক্তচাপের কারনসমুহ
প্রকৃতপক্ষে বেশীরভাগ রোগীর ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোন কারন জানা থাকেনা। একে প্রাথমিক উচ্চ রক্তচাপ বলে। সাধারনত বয়স বাড়ার সাথে সাথে উচ্চ রক্তচাপের হারও বাড়তে থাকে। কিছু কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। সেগুলো নি¤েœ আলোচনা করা হল-
বংশগতিঃ বংশানুক্রমিক ধারা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। মা, বাবা এবং আত্মীয়স্বজনের উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সন্তানেরও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়। যেটি মূলত বংশগতির ধারারই প্রতিফলন।
ধূমপানঃ যারা ধূমপান করে তাদের নিকোটিন সহ অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক ধোঁয়ার মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়।
অতিরিক্ত লবণ খাওয়াঃ অনেকেই পাতে লবণ খেতে পছন্দ করে থাকে। এই বাড়তি লবণ খেলে রক্তে সোডিয়ামের পরিমান বেড়ে যায় এবং দেহে তরলের ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। ফলে কিডনিরও কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং রক্ত নালীতে চাপ বাড়ার কারনে রক্তচাপ বেড়ে যায়।
স্থুলতা বা মোটা হওয়াঃ অতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্রকে বেশি পরিশ্রম করতে হয় তাই রক্তচাপ বেড়ে যায় খুব দ্রæত। কারন স্থুলতার জন্য রক্তনালীগুলোও সরু হয়ে যায় ফলে উচ্চ রক্তচাপের প্রবনতাও বেড়ে যায়। এছাড়া কায়িক পরিশ্রম না করলে ওজন বেড়ে যেতে পারে এবং তা উচ্চ রক্তপাপের কারন হতে পারে।
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যভাসঃ অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাদ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য এবং অতিরিক্ত চিনিসমৃদ্ধ খাবার দেহে চর্বির পরিমান বাড়িয়ে দেয়। এবং ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এলডিএল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এলডিএল রক্তনালীতে রক্ত চলাচলে বাধা প্রদান করে এবং রক্তচাপ বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষের উচ্চ রক্তচাপের কারন এই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস।
মদ্যপানঃ মদ্যপান দেহের ওজন বাড়াতে সহায়তা করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়।
মানসিক চাপঃ অতিরিক্ত মানসিক চাপ রক্ত চলাচলের গতি বৃদ্ধি করে। কারন মানুষ যখন মানসিক চাপের মধ্যে থাকে তখন হৃদযন্ত্রেও ক্রিয়া বেড়ে যায় ফলে রক্তচাপও বেড়ে যায়।
এছাড়াও কিছু কিছু রোগের জন্য উচ্চরক্তচাপ হতে পারে। নির্দিষ্ট কারন খুজে না পেলে একে গৌণ উচ্চ রক্তচাপ বলে। কারনগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- কিডনির রোগ, নিদ্রাহীনতা, জন্মগত হৃদরোগ, থাইরয়েডের সমস্যা, ঔষধের পাশ^র্ প্রতিক্রিয়া, অবৈধ ড্রাগ ব্যবহার, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির সমস্যা, স্টেরয়েড হরমোন গ্রহন ইত্যাদি।
উচ্চরক্তচাপের লক্ষণসমুহ
মাথাব্যথা, নিঃশ^াস নিতে কষ্ট হওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, অনিদ্রা, মাথা ঘোরা, বুক ব্যথা, শরীরের চাক্ষুষ পরিবর্তন, প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া, দৃষ্টিতে সমস্যা হওয়া, অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, ক্লান্তি।
উচ্চরক্তচাপের রোগীর পথ্যব্যাবস্থাপনা ঃ
উচ্চরক্তচাপের রোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ্য হলো ড্যাশ ডায়েট। ড্যাশ ডায়েট অর্থ হলো ডায়েটারি এপ্রোচ টু স্টপ হাইপারটেনশান। অর্থাৎ এই ডায়েটটি মূলত উচ্চরক্তচাপ প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়। এতে প্রচুর পরিমানে ফলমূল ও শাকসবজি খেতে বলা হয় এবং আরো কিছু খাবার যেমন মাছ, কম ¯েœহযুক্ত দুধ ইত্যাদি খেতে বলা হয়। তাছাড়া তেল ও সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবার যেমন খাবার লবণ কম খেতে বলা হয় ।
উচ্চরক্তচাপ হলে কি খাবেন?
আঁশ যুক্ত খাবার যেমন সবধরনের শাক, সবজি-বিশেষত খোসা সহ সবজি যেমন ঢেড়স, বরবটি, সিম ইত্যাদি, সব ধরনের ডাল, টক জাতীয় ফল বা খোসা সহ ফল ইত্যাদি। উপকারী চর্বি ও অসম্পৃক্ত চর্বি জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে- যেমন সব ধরনের সামুদ্রিক মাছ, ছোট মাছ, উদ্ভিজ তেল (কর্ণ অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি)। এছাড়াও পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফল এবং সবজিতে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম আছে এবং এগুলোতে সোডিয়ামের পরিমাণও কম। আস্ত ফল এবং সবজি খাওয়া জুস খাওয়ার চেয়ে ভালো, কারণ জুসে খাবারের আঁশ বাদ পড়ে যায়। এছাড়াও বাদাম, শস্যদানা, ডাল, চর্বি ছাড়া মাংস, মুরগি ম্যাগনেসিয়ামের ভালো উৎস। খাবারের সাথে বেশি পরিমাণে পটাশিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম চাইলে নীচের খাবারগুলো খেতে হবে যেমন আপেল, অ্যাপ্রিকট, কলা, শালগম, ব্রকলি, গাজর,বরবটি, আঙুর, বরবটি, আম, তরমুজ, কমলা, আনারস, টমেটো, সামুদ্রিক মাছ।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কি খাবেন না?
কোলেস্টেরলযুক্ত এবং সমৃদ্ধ চর্বি যুক্ত খাবার যেমন - ডিমের কুসুম, কলিজা, মাছের ডিম, খাসি বা গরুর চর্বিযুক্ত মাংস, হাস-মুরগীর চামড়া, হাড়ের মজ্জা, ঘি, মাখন, ডালডা, মার্জারিন, গলদা চিংড়ি, নারিকেল এবং উল্লেখিত এসব দ্বারা তৈরী খাবার।
যেসব খাবার পরিমিত পরিমানে খাবেন
শর্করা জাতীয় খাবার যেমন ভাত, আলু, রুটি ইত্যাদি। মিষ্টি জাতীয় ফল যেমন পাকা আম, পাকা পেপে, পাকা কলা ইত্যাদি। দুধ ও দুধের তৈরী খাবার।
একেবারেই খাওয়া নিষেধ যেসব খাবার
অতিরিক্ত লবন খাওয়া যাবে না, পাতে লবন ও নোনতা খাবার পরিহার করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের ফাস্ট ফুড, কেক, পুডিং, আইসক্রিম, বোতল জাত কোমল পানীয় ইত্যাদি। এছাড়া কোনো রোগীর যদি ডায়াবেটিস থেকে থাকে তাহলে তাকে ডায়াবেটিসের খাদ্য তালিকাও এর সাথে মেনে চলতে হবে। আসুন এবার জেনে নেয়া যাক কিভাবে লবণ খাওয়া কমাবেন- বেশি লবণ বা সোডিয়ামযুক্ত খাবার বেশিরভাগ মানুষেরই রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয়। তাই যত কম লবণ বা সোডিয়াম খাবেন, তত সহজ হবে আপনার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা।
খাবারে সোডিয়ামের পরিমাণ কমাতে নীচের কাজগুলো করতে পারেন-
কতখানি লবণ খাচ্ছেন তার হিসেব রাখতে ফুড ডায়রি লেখা শুরু করুন।
দৈনিক ২৩০০ মিলিগ্রাম বা ১ চা চামচের কম লবণ খাবার চেষ্টা করুন। ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে দেখুন যে এর চেয়ে কম খেলে যেমন ১৫০০ মিলিগ্রাম, আপনার কোনো সমস্যা হবে নাকি।
খাবার কিনে খেলে তার প্যাকেটের গায়ে লেখা উপকরণ ভালোভাবে পড়ে দেখুন।
দৈনিক ৫ শতাংশের কম সোডিয়াম খাওয়া হবে এমন খাবার কিনুন।
দৈনিক ২০ শতাংশের বেশী সোডিয়াম খাওয়া হবে এমন খাবার এড়িয়ে চলুন।
প্রক্রিয়াজাত খাবার, রেডি টু ইট বা তৈরি খাবার, ফাস্টফুড এড়িয়ে চলুন।
উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের জন্য কিছু সাধারণ পরামর্শ
১. উচ্চ রক্ত চাপ নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
২. পরামর্শ পত্রে প্রদত্ত ওষুধ নিয়মিত সেবন করুন।
৩. প্রতিদিন হাটুন অথবা ব্যায়াম করুন, ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
৪. ধূমপান, জর্দা, তামাক পাতা, গুল পরিহার করুন।
৫. দুঃশ্চিন্তা মুক্ত থাকুন।
৬. ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করুন ও নিয়ন্ত্রনে রাখুন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটিই প্রতীয়মান হয় যে খাদ্যাভাস এবং জীবনযাপনের ধরন পরিবর্তন ই উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রনের মূল চাবিকাঠি। তাই আসুন পুষ্টিবিদদের পরামর্শ মেনে চলি। সুস্থ্য সবল উচ্চ রক্তচাপ মুক্ত জীবনযাপন করি।
ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ,
জীববিজ্ঞান অনুষদ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় , বাংলাদেশ।
মোবাইল: ০১৭৩৮৫৯৪৫৩৯
billalanftiu@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন