মানুষের ব্যক্তিজীবন ও সমাজজীবনের সর্বত্র এমন কিছু নাজুক মূহুর্ত আসে যখন কোনো বৃহৎ কামিয়াবি অথবা বিফলতার দ্বারা মানুষ অধির হয়ে পড়ে। এ সময়ে বৈধ ও সহনশীলতার সাথে কাজ করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু আত্মসংযমের এটাই আসল সময় এবং এর দ্বারাই ব্যক্তি ও সমাজে দেখা দেয় হৃদ্যতা, সহমর্মিতা ও একতার সুদৃঢ় বন্ধন। এই পৃথিবীতে খুশি ও আনন্দ, সুখ ও দুঃখ হচ্ছে আপেক্ষিক ব্যাপার। তাই উভয় অবস্থায়ই মানুষের উচিত আত্মসংযম অবলম্বন করা এবং নিজেকে বশে রাখার প্রবণতা গ্রহণ করা। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে সংযত রাখা যে, খুশি ও আনন্দের ফলে যেন মনে-প্রাণে অহঙ্কার ও অহমিকার ভাব পয়দা না হয়। অপর দিকে দুঃখ ও বেদনার সময়ও যেন অধীর, উদাস ও বিষন্ন না হয়।
এই উভয় অবস্থায় সীমার ভেতরে থাকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে দৃঢ়তা ও আত্মসংযম। মানব জীবনের বহুমুখী প্রবৃত্তিকে সুসংহত করার এটাই একমাত্র পথ। এ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘যদি আমি নিজের পক্ষ হতে মানুষকে কোনো রহমত ও মেহেরবানী দান করি এবং পরে তা উঠিয়ে নেই, তাহলে সে নিরাশ ও অকৃতজ্ঞ হয়ে যায়। আর যদি কোনো মুসিবতের পরে নেয়ামতের আস্বাদ গ্রহণ করাই, তখন বলে সকল অমঙ্গল আমা হতে দূর হয়ে গেছে। অবশ্যই সে তখন খুশি ও আনন্দে নিমগ্ন হয়। কিন্তু যারা নফসের ওপর ক্ষমতাবান এবং পুণ্যকর্মে যত্মশীল, তাদের জন্যই রয়েছে ক্ষমা এবং বৃহত্তর বিনিময়। (সূরা হুদ : ১০)।
বস্তুত: গোলযোগপূর্ণ ঘটনাবলি ও বিপদপূর্ণ অবস্থায় ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে কাজ করার এক ধাপ উপরে সে আত্মসংযমের মর্যাদা তা নতুন করে বলার অবকাশ নেই। আত্মসংযমী মানুষ জীবনভর যে কোনো অবস্থায় সুদৃঢ়ভাবে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করতে পারে। ধর্মীয় ফারায়েজ ও হুকুম আহকাম পালন করা সব সময়ই মানুষের কাছে কঠিন বলে মনে হয়। এমতাবস্থায় জীবনভর ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে এ সকল কাজ আদায় করাই হচ্ছে প্রকৃত ধৈর্য ও আত্মসংযম।
মোটকথা, সকল কাজে আল্লাহর হুকুমের ফরমাবরদারি ও আনুগত্য প্রকাশে মনে প্রাণে লেগে থাকা একটি বড় পরীক্ষা। এজন্যই আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, নিশ্চয়ই আল্লাহ নভোমন্ডল-ভূমন্ডল ও তন্মধ্যস্থ সব কিছুর প্রতিপালক, সুতরাং তারই ইবাদত বন্দেগি করো এবং ধৈর্যসহ আনুগত্য প্রকাশ কর। (সূরা মারয়াম : ৬৫)। মোটকথা, সারা জীবন এই দায়িত্ব পালন করার মনোবৃত্তি গ্রহণ করতে হবে।
নেককাজ সমূহ অনুক‚ল ও প্রতিক‚ল উভয় অবস্থায় সানন্দচিত্তে জীবনভর আদায় করার লক্ষ্যে সুদৃঢ় থাকা দরকার। অপরদিকে খারাপ কাজ সমূহ চিত্তাকর্ষক ও আরাম আয়েশে পরিপূর্ণ হলেও তা পরিহার করা অপরিহার্য। রাতে দুগ্ধ ফেননিভ কোমল বিছানা পরিত্যাগ করে আল্লাহর দরবারে সিজদাহবনত হওয়া, সুখস্বপ্নপূর্ণ নিদ্রা ত্যাগ করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা, নাজ ও নেয়ামতের প্রাচুর্য থাকা সত্তে¡ও রোজা পালন করা, দুঃখ ও বেদনার ভয় থাকা সত্তে¡ও প্রয়োজনকালে সত্য কথা বলা এবং সত্যমত ও পথকে কবুল করা এবং সত্যের পথে সকল প্রতিক‚লতা উপেক্ষা করে মনের আনন্দে অগ্রসর হওয়া, সুদ ও অসদোপায়ে অর্থ উপার্জন পরিত্যাগ করা, রূপ ও যৌবনের অশুভ পায়তারাকে বর্জন করা ইত্যাদিই হচ্ছে সত্যিকারভাবে আত্মসংযমের পরিচায়ক।
এই বিশ্লেষণের পাশাপাশি এই হাদিসটির কথাও স্মরণে রাখা একান্ত দরকার। পিয়ারা নবী সা. বলেছেন, ‘জান্নাত নাখোশীর কাজসমূহ এবং দোযখ নাফসানী আরাম আয়েশের কাজসমূহ দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে পড়েছে। (সহীহ মুসলিম বোখারী।
এই হাদিসের আলোকে বোঝা যায় যে, ওই সকল পুণ্যের কাজ সম্পাদন করা, যার বিনিময়ে জান্নাত রয়েছে, তা খুবই কষ্টকর ও কঠিন। অপরদিকে যে সকল কাজ দ্বারা দোযখের শাস্তি অবধারিত হয়, সেগুলো বাস্তব জীবনে খুবই আরামদায়ক মনে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন