সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

করোনা কি শুধুই আল্লাহর আযাব

মুহাম্মাদ ইরফান হাওলাদার | প্রকাশের সময় : ১১ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

সাহাবীদের সময়ে একবার মহামারি প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই প্লেগে আক্রান্ত হয়ে শাহাদাতবরণ করেন অনেক সাহাবী। তার মধ্যে একজন ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী।

৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফা ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)। ওই সময় প্লেগ দেখা দিয়েছিল সিরিয়া ও প্যালেস্টাইনে। ইতিহাসে যা ‘আম্মাউস প্লেগ’ নামে পরিচিত। উমর (রা.) সিরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিলেন। ‘সারগ’ নামক জায়গায় পৌঁছার পর সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রা.) খলিফাকে জানালেন, সিরিয়ায় তো প্লেগ দেখা দিয়েছে।

উমর (রা.) প্রবীণ সাহাবীদেরকে পরামর্শের জন্য ডাকলেন। এখন কী করব? সিরিয়ায় যাবো নাকি যাবো না? সাহাবীদের মধ্য থেকে দুটো মত আসলো। একদল বললেন, ‘আপনি যে উদ্দেশে বের হয়েছেন, সে উদ্দেশে যান’। আরেকদল বললেন, ‘আপনার না যাওয়া উচিত’।

তারপর আনসার এবং মুহাজিরদের ডাকলেন পরামর্শ দেবার জন্য। তারাও মতপার্থক্য করলেন। সবশেষে বয়স্ক কুরাইশদের ডাকলেন। তারা এবার মতানৈক্য করলেন না। সবাই মত দিলেন, ‘আপনার প্রত্যাবর্তন করা উচিত। আপনার সঙ্গীদের প্লেগের দিকে ঠেলে দিবেন না।’

উমর (রা.) তাঁদের মত গ্রহণ করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মদীনায় ফিরে যাবেন। খলিফাকে মদীনায় ফিরে যেতে দেখে সেনাপতি আবু উবাইদাহ (রা.) বললেন, ‘আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর থেকে পালানোর জন্য ফিরে যাচ্ছেন?’ আবু উবাইদাহর (রা.) কথা শুনে উমর (রা.) কষ্ট পেলেন। আবু উবাইদাহ (রা.) ছিলেন তাঁর এতো পছন্দের যে, আবু উবাইদাহ (রা.) এমন কথা বলতে পারেন উমর (রা.) সেটা ভাবেননি।

উমর (রা.) বললেন, ‘ও আবু উবাইদাহ! যদি তুমি ব্যতীত অন্য কেউ কথাটি বলতো! আর হ্যাঁ, আমরা আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাচ্ছি।’ আল্লাহর এক তাকদীর থেকে আরেক তাকদীরের দিকে ফিরে যাওয়ার মানে কী? উমর (রা.) সেটা আবু উবাইদাহকে রা. বুঝিয়ে বলেন, ‘তুমি বলতো, তোমার কিছু উটকে তুমি এমন কোনো উপত্যকায় নিয়ে গেলে যেখানে দু’টো মাঠ আছে। মাঠ দু’টোর মধ্যে একটি মাঠ সবুজ শ্যামল, আরেক মাঠ শুষ্ক ও ধূসর। এবার বলো, ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, তুমি সবুজ মাঠে উট চরাও তাহলে তা আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো। আর যদি শুষ্ক মাঠে চরাও, তা-ও আল্লাহর তাকদীর অনুযায়ী চরিয়েছো।’

অর্থাৎ, উমর (রা.) বলতে চাচ্ছেন, হাতে সুযোগ থাকা সত্তে¡ও ভালোটা গ্রহণ করা মানে এই না যে আল্লাহর তাকদীর থেকে পালিয়ে যাওয়া। কিছুক্ষণ পর আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) আসলেন। তিনি এতক্ষণ অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি এসে রাসূল (সা.)-এর একটি হাদীস শুনালেন। ‘তোমরা যখন কোনো এলাকায় প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করো না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না।’ (সহীহ বুখারী : ৫৭২৯)।

রাসূল (সা.)-এর হাদীসটি সমস্যার সমাধান করে দিলো। উমর (রা.) হাদীসটি শুনে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। মদীনায় ফিরে উমর (রা.) আবু উবাইদাহকে (রা.) চিঠি লিখলেন। ‘আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। আমার এই চিঠিটি যদি রাতের বেলা আপনার কাছে পৌঁছে, তাহলে সকাল হবার পূর্বেই আপনি রওয়ানা দিবেন। আর চিঠিটি যদি সকাল বেলা পৌঁছে, তাহলে সন্ধ্যা হবার পূর্বেই আপনি রওয়ানা দিবেন।’

চিঠিটা পড়ে আবু উবাইদাহ (রা.) বুঝতে পারলেন। খলিফা চাচ্ছেন তিনি যেন প্লেগে আক্রান্ত না হন। অথচ একই অভিযোগ তো তিনি উমরকে (রা.) করেছিলেন। প্রতিউত্তরে আবু উবাইদাহ (রা.) লিখেন, ‘আমিরুল মুমিনিন, আমি তো আপনার প্রয়োজনটা বুঝতে পেরেছি। আমি তো মুসলিম মুজাহিদদের মধ্যে অবস্থান করছি। তাদের মধ্যে যে মুসিবত আপতিত হয়েছে, তা থেকে আমি নিজেকে বাঁচানোর প্রত্যাশী নই। আমি তাদেরকে ছেড়ে যেতে চাই না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ও তাদের মাঝে চ‚ড়ান্ত ফয়সালা করে দেন। আমার চিঠিটি পাওয়ামাত্র আপনার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুন এবং আমাকে এখানে অবস্থানের অনুমতি দিন।’

চিঠিটি পড়ে উমর (রা.) ব্যাকুলভাবে কান্না করেন। তার কান্না দেখে মুসলিমরা জিজ্ঞেস করল, ‘আমিরুল মুমিনিন, আবু উবাইদাহ কি ইন্তেকাল করেছেন?’ উমর (রা.) বললেন, ‘না, তবে তিনি মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।’ (আসহাবে রাসূলের জীবনকথা, আব্দুল মাবুদ, প্রথম খন্ড, পৃ. ৯৩-৯৪)। কিছুদিন পর আবু উবাইদাহ (রা.) প্লেগে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত হবার অল্পদিনের মধ্যেই শাহাদাতবরণ করেন।

রাসূল (সা.) বলেন, ‘(প্লেগ) মহামারীতে মৃত্যু হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের জন্য শাহাদাত।’ (সহীহ বুখারী : ২৮৩০)। আবু উবাইদাহ (রা.) ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী। আশারায়ে মুবাশশারার একজন। রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খলিফা নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠলে আবু বকর (রা.) আবু উবাইদাহকে (রা.) প্রস্তাব করেন। উমর (রা.) ইন্তেকালের আগে কে পরবর্তী খলিফা হবেন এই প্রশ্ন উঠলে তিনি বলেন, ‘যদি আবু উবাইদাহ বেঁচে থাকতেন, তাহলে কোনো কিছু না ভেবে তাঁকেই খলিফা বানাতাম।’

রাসূল (সা.) প্লেগ সম্পর্কে বলেন, ‘এটা হচ্ছে একটা আজাব। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাদের উপর ইচ্ছা তাদের উপর তা প্রেরণ করেন। তবে, আল্লাহ মুমিনদের জন্য তা রহমতস্বরূপ করে দিয়েছেন। কোনো ব্যক্তি যদি প্লেগে আক্রান্ত জায়গায় সওয়াবের আশায় ধৈর্য ধরে অবস্থান করে এবং তার অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে, আল্লাহ তাকদীরে যা লিখে রেখেছেন তাই হবে, তাহলে সে একজন শহীদের সওয়াব পাবে।’ (সহীহ বুখারী : ৩৪৭৪)।
করোনাভাইরাস অনেক জায়গায় মহামারি আকার ধারণ করেছে। সারাবিশ্বে এখন আলোচিত টপিক হলো করোনাভাইরাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এর থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে ব্যস্ত। বিভিন্ন দেশের বিমানবন্দর, স্টেশনগুলোতে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সবমিলিয়ে পুরো বিশ্ব একটা আতঙ্কের মধ্যে আছে। সম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশেও এই রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।

ঠিক এই মুহূর্তে প্রশ্ন উঠছে, করোনাভাইরাস কি আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো আজাব? রাসূল (সা.) এর হাদীস থেকে দেখতে পাই, প্লেগকে তিনি বলেছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব, আবার বলেছেন এটা মুমিনদের জন্য শর্তসাপেক্ষে রহমত। একই মহামারি ভাইরাস কারো জন্য হতে পারে আজাব, আবার কারো জন্য হতে পারে রহমত। তাই বলে, একে ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব কিংবা ঢালাওভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত বলার সুযোগ নেই।

করোনার ব্যাপারে যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। সেই সাথে প্রয়োজন আল্লাহর কাছে দোয়া করা, নিজেদের গুনাহের জন্য মাফ চাওয়া। তারপরও যদি আল্লাহ না করুক, করোনায়-আক্রান্ত হই তাহলে ধৈর্য ধরা। আল্লাহর হুকুমের ওপর সন্তুষ্ট হওয়া এবং শাহাদাতের পেয়ালাপানে উন্মুখ থাকা। আল মাহমুদের মতো বলব ‘ভালো মন্দ যা কিছু ঘটুক, মেনে নেবো এ আমার ঈদ’। কারণ ‘আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সব বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য।’ (সূরা আল আনাম: ১৬২)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (10)
তানবীর ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:০৬ এএম says : 0
সুন্দর যৌক্তিক ও তথ্যবহুল একটি লেখা।
Total Reply(0)
রিপন ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:০৭ এএম says : 0
সময় উপযোগী এই লেখাটির জন্য মুহাম্মাদ ইরফান হাওলাদার সাহেবকে অসংখ্য ধন্যবাদ
Total Reply(0)
সফিক আহমেদ ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:০৮ এএম says : 0
আল্লাহ আমাদেরকে তার আজাব থেকে বাঁচার ও রহমতকে কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুক।
Total Reply(0)
আরমান ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:০৯ এএম says : 0
করোনা নিয়ে আমার পড়া সবচেয়ে ভালো ও সঠিক লেখা
Total Reply(0)
জাবেদ ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:১০ এএম says : 0
করোনার ব্যাপারে যথাযথ প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার।
Total Reply(0)
আবেদ খান ১১ মার্চ, ২০২০, ৩:১০ এএম says : 0
প্রয়োজন আল্লাহর কাছে দোয়া করা, নিজেদের গুনাহের জন্য মাফ চাওয়া।
Total Reply(0)
Md.ziauddin ahmed ১১ মার্চ, ২০২০, ৭:৩২ এএম says : 0
আল্লাহ আমাদেরকে তার আজাব থেকে বাঁচার ও রহমতকে কাজে লাগানোর তৌফিক দান করুক।
Total Reply(0)
রনি ১১ মার্চ, ২০২০, ৮:২৬ এএম says : 0
খুব ভালো লাগল পড়ে ।
Total Reply(0)
সাইফ ১১ মার্চ, ২০২০, ১০:০০ এএম says : 0
আল্লাহ্‌ জনাব লেখক সাহেব ও ইনকিলাব সংশ্লিষ্ট সকলকে এর উত্তম প্রতিদান অবশ্যই দেবেন। সময় উপযোগি অতিব ঈমান আফরোজ এই লেখার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের সকলের প্রতি রহমত করুণ।
Total Reply(0)
আহমেদ ১৪ মার্চ, ২০২০, ১১:৩২ পিএম says : 0
আপনাকে ধন্যবাদ
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন