প্রিয় নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. হলেন সরওয়ারে আম্বিয়া এবং সাইয়্যেদে আওলাদে আদম। এ জন্যই তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্র অধিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত হয়ে ছিলেন এবং লা মাকান পরিমন্ডলে এত খানি নৈকট্য ও উন্নতি অর্জন করেছিলেন, যেখানে তার পূর্বে কোনো বনী আদমের কদম পড়েনি এবং তিনি ওই সকল বস্তু দর্শন করেছেন, যা কোনো কালের আল্লাহর কোনো প্রিয় বান্দাহর দৃষ্টিশক্তি অবলোকন করতে সক্ষম হয়নি। আর এটাই হচ্ছে আল্লাহ পাকের ঘোষণা, ‘ওয়া রাফায়না লাকা যিকরাকা’ এর মর্মবাণী। অর্থাৎ, এবং আমিই আপনার খ্যাতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি।’ (সূরা ইনশিরাহ : ৪১)।
বিশ^নবী হযরত মোহাম্মাদ মুস্তফা আহমাদ মুজতবা সা.-এর মহা মর্যাদাপূর্ণ এই সায়েরে মালাকুতকে দু’টি অংশে বিভক্ত করে জ্ঞানী মোনীষীগণ বিশ্লেষণ করেছেন। এর প্রথম অংশটি হলো আসরা এবং দ্বিতীয় অংশটি হলো মিরাজ। আল কোরআন ও সুন্নায় এই দুই অংশের বিবরণ সুস্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে। আরবি ‘আসরা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে কোনো বস্তুকে রাতে চালিয়ে নেয়া বা রাত্রে নিয়ে যাওয়া বা ভ্রমণ করানো।
যেহেতু বিশ্বনবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-এর এই অতি প্রাকৃত আশ্চর্যজনক ভ্রমণ রাতেই সংগঠিত হয়েছিল এজন্য তাকে আসরা বলা হয়। আল কোরআনে এভাবে-এর বিশ্লেষণ করেছে। ইরশাদ হয়েছে, পবিত্র ও মহিময় তিনি যিনি তার বান্দাকে রজনীযোগে মসজিদুল হারাম হতে মসজিদুল আকসায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন, যার পরিবেশ আমি বরকতময় করেছিলাম, তাকে আমার নিদর্শন দেখাবার জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা ইসরা বা বানী ইসরাঈল : ১)।
এই আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকালে আসরা বা রজনীযোগে ভ্রমণের সার্বিক চিত্র সকল মানুষের সামনে প্রভাত সূর্যের মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। যেমন: (ক) কে ভ্রমণ করিয়েছিলেন? উত্তর, যিনি পবিত্র ও মহিমময়, অর্থাৎ আল্লাহ। (খ) কাকে ভ্রমণ ভ্রমণ করিয়েছেন? উত্তর, তার বান্দা মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-কে। (গ) কোন স্থান হতে ভ্রমণ শুরু হয়েছিল? উত্তর, মক্কার মাসজিদুল হারাম হতে। (ঘ) কোন স্থান হয়ে ভ্রমণ কাফেলা সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছিল? উত্তর, জেরুজালেমে অবস্থিত মাসজিদুল আকসা হয়ে।
(ঙ) কেন এই ভ্রমনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল? উত্তর, নূর নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-কে আল্লাহপাকের আয়াত বা নিদর্শনাবলি দেখাবার জন্য। (চ) এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহপাক প্রথমে তৃতীয় পুরুষ ও পরে উত্তম পুরুষ সংকেত নিজের জন্য ব্যবহার করেছেন। তা কি ব্যাকরণ সম্মত? উত্তর, আরবি অলঙ্কার শাস্ত্র অনুসারে পরস্পর সংলগ্ন দু’টি বাক্যে একই কর্তার উত্তম পুরুষ ও তৃতীয় পুরুষ সংকেতের ব্যবহার ব্যাকরণ সম্মত ও সিদ্ধ। এর উদাহরণ হলো সূরা মায়িদাহ এর ১২ নং আয়াত। যথা, ‘আল্লাহ বনী ইসরাঈল অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্য হতে দ্বাদশ নেতা নিযুক্ত করেছিলাম, আর আল্লাহ বলেছিলেন, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, তোমরা যদি সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও আমার রাসূলগণে ঈমান আন ও তাদেরকে সম্মান কর এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান কর, তবে তোমাদের পাপ অবশ্যই মোচন করব এবং নিশ্চয়ই তোমাদেরকে জান্নাতে দাখিল করব, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, এরপরও কেউ কুফুরি করলে সে সরল পথ হারাবে।’
(ছ) মাসজিদুল হারাম হতে যাত্রা শুরু করে মাসজিদুল আকসায় পৌঁছা পর্যন্ত রাসুলুল্লাহ সা. কি আরও কোনো স্থান ভ্রমণ করেছেন? উত্তর, হ্যাঁ করেছেন। যেমন মদীনা মুনাওয়ারা ও মাকবারায়ে হযরত মূসা আ.। (জ) মি’রাজ একবার হয়েছে, নাকি কয়েকবার হয়েছে? উত্তর, সহীহ সনদ সূত্রে বর্ণিত হাদীস সমূহের বর্ণনা অনুসারে এবং জমহুর উলামাদের রায় মোতাবেক মি’রাজ শুধু একবারই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আর যারা বহু বারের দাবিদার-এর আসল কারণ হচ্ছে এই যে, মি’রাজের বর্ণনাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন অংশে এখতেলাফ আছে।
এজন্য তারা সেই এখতেলাফ অপনোদনের জন্য মি’রাজ কয়েকবারের কথা স্বীকার করেছেন। যেন প্রত্যেক বিতর্কিত ঘটনাকে পৃথক পৃথকভাবে মি’রাজের সঙ্গে সমন্বয় করা যায়। মোটের ওপর এটা তাদের একটা কষ্ট কল্পনামাত্র। যার মূল হাকীকতের সাথে কোনোই সম্পর্ক নেই, সহীহ সনদ সম্বলিত হাদীসের বর্ণনাবলি আমাদের সামনে আছে। এগুলোর মাঝে কয়েকবার মি’রাজ হওয়ার ইশরা পর্যন্ত নেই।
বস্তুত: মি’রাজ মানব শক্তির অতীত প্রত্যক্ষ দর্শন সম্বলিত বিস্তৃত ঘটনা, যখন মুসলমানদের সংখ্যা ছিল কম এবং যা কিছু ছিল তাও বিচ্ছিন্নভাবে এবং বিভিন্ন ধ্যান-ধারণার অনুসারী। আর এই ঘটনার অধিকাংশ বর্ণনাকারী এমন লোক যারা তখনো পয়দাই হয়নি অথবা অনেক অল্প বয়স্ক ছিলেন অথবা তারা মদীনার অধিবাসী। যাদের মাধ্যম ছাড়া হিজরত পূর্ববর্তী ঘটনাবলির মৌলিক অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় না। তাই তাদের বর্ণনায় সামান্য এখতেলাফ পাওয়া গেলেও তার সমন্বয় সাধনের জন্য কষ্ট কল্পনার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ এ সম্পর্কে সহীহ বর্ণনার সাক্ষ্য রয়েছে। তাই মি’রাজের মূল ঘটনা এবং এর বিশেষ অংশের অনুষ্ঠিত হওয়া সম্পর্কে কোনো দ্বিধা এবং সন্দেহ থাকার কোনোই অবকাশ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন