বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ মোস্তফা আহমাদ মুজতাবা সা.-এর সায়েরে মালাকুতের দ্বিতীয় অংশটি মি’রাজ নামে খ্যাত। মি’রাজ শব্দটি আরবী ‘উরূজ’ মূলধাতু থেকে উদগত। যেহেতু হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সা. ‘উরিজা লী’ অর্থাৎ আমাকে উর্ধজগতে আরোহন করানো হয়েছে, শব্দটি ব্যবহার করেছেন, এজন্য সায়েরে মালাকুতের সমগ্র ঘটনাকে মি’রাজ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মোট কথা, যখন ইসলামের সবচেয়ে নাজুক ও সঙ্কটপূর্ণ যুগ সমাপ্ত হওয়ার পথে ছিল এবং হিজরতের পর হতে শান্তি ও নিরাপত্তার এক নতুন যুগের শুভ সূচনা অত্যাসন্ন ছিল, তখন সেই বরকতময় রাতের আগমন ঘটল এবং সে মুবারক রাতে সৌভাগ্যের সে সময় এগিয়ে আসল, যা মহাশূন্যের বাগানে রাসূলুল্লাহ সা.-এর ভ্রমণের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। যার মাঝে আল্লাহর দরবার হতে নির্দিষ্ট আহকামের বিধিবদ্ধ হওয়া এবং তা কাজে পরিণত করার নির্দেশাবলী ছিল। তাই জান্নাতের দারোগা রিদওয়ান ফিরিশতাকে হুকুম দেয়া হলো, যেন আজ অদৃশ্য জগতের মেহমান খানাকে নতুন সাজ-সরঞ্জামে সুসজ্জিত করা হয়। আজ হাবীবে কিবরিয়া মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. সারা বিশ্ব প্রত্যক্ষকারী মেহমান হয়ে আগমন করলেন।
ফিরিশতাদের সর্দার জিব্রাঈল ফিরিশতাকে নির্দেশ দেয়া হলো বিদ্যুৎ হতে দ্রুতগামী আলো হতে অধিক গতিশীল যানবাহন যা লাহুত ও হাপুত জগতের মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত হেরেমে কাবায় যেন তা নিয়ে উপস্থিত হন। একই সাথে কার্যকরী উপাদানসমূহকে নির্দেশ দেয়া হলো নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের যাবতীয় বস্তুভিত্তিক নিয়ম-নীতি যেন কিছুক্ষণের জন্য নিস্ক্রিয় করে দেয়া হয় এবং স্থান-কাল, ভ্রমণ, একামত, দর্শন, শ্রবণ ও বাক্য বিন্যাসের সকল সহজাত নিয়মালী যেন উঠিয়ে নেয়া হয়। ফলে তাই করা হলো, যেমনটি আল্লাহর মর্জি ছিল।
বস্তুত: এক লক্ষ চব্বিশ হাজার আম্বিয়ায়ে কেরামের রূহানী হালত এবং জীবনের ঘটনাবলীর প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে স্পষ্টতঃই বোঝা যায় যে, উলুল আযম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ মর্যাদাশালী পয়গাম্বরদের নবুওতের প্রারম্ভে বা নবুওতের দায়িত্ব পালনকালে কোনো নির্দিষ্ট লগ্নে ও সময়ে এই সায়েরে মালাকুতের বুলন্দ মর্তবা নসীব করা হয়েছে। এবং সে সময়ে দর্শনের যাবতীয় বস্তুভিত্তিক শর্তাবলীর পর্দা তাদের চোখের সম্মুখ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। স্থান ও কালের যাবতীয় কাল্পনিক প্রতিবন্ধকসমূহ তাদের যাত্রাপথ হতে দূরীভ‚ত করা হয়েছে।
এতে করে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপনীয় দৃশ্যাবলী উন্মুক্তভাবে তাদের সামনে হাজির হয়েছে এবং তারা এরপর নূরের বেহেশতী জামা পরিধান করে ফিরিশতাদের রূহানী শোভাযাত্রার সাথে আল্লাহর সান্নিধানে উপস্থিত হয়েছেন এবং নিজ নিজ মর্তবা ও পর্যায় অনুসারে অনুকূল অধিষ্ঠানে দাঁড়িয়ে ফয়েজে রাব্বানী দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করত: নূরের দরিয়ায় আবগাহন করেছেন। এমনকি কোনো কোনো খাস মোকাররাবীনকে এমন মর্যাদাও দান করা হযেছে যে, তারা পবিত্র দর্শনের সংরক্ষিত অধিষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে কাবা কাউসাইনের চেয়েও কম দূরত্বে থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের নির্দিষ্ট ফরমান নিয়ে এই মাটি ও পানির রঙ্গমঞ্চে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
হযরত ইব্রাহীম আ.-কে যখন নবুওত প্রদান করা হয়, তখন ফয়েজে রাব্বানী দ্বারা পরিপূর্ণতা লাভ করত: নূরের দরিয়ায় আবগাহন করেছেন। এমনকি কোনো কোনো খাস মোকাররাবীনকে এমন মর্যাদাও দান করা হযেছে যে, তারা পবিত্র দর্শনের সংরক্ষিত অধিষ্ঠানে উপস্থি হয়ে কাবা কাউসাইনের চেয়েও কম দূরত্বে থেকে দায়িত্ব ও কর্তব্যের নির্দিষ্ট ফরমান নিয়ে এই মাটি ও পানির রঙ্গমঞ্চে প্রত্যাবর্তন করেছেন।
হযরত ইব্রাহীম আ.-কে যখন নবুওত প্রদান করা হয়, তখন ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং এভাবেই আমি ইব্রাহীম আ.-কে নভোমন্ডল এবং ভূমন্ডলের বাদশাহী দেখিয়েছি।’ এই সায়েরে মালাকুত অর্থাৎ, আসমান ও জমিনের বাদশাহী প্রত্যক্ষ করার নামই কোরআন ও হাদীসের ভাষায় আসরা বা মি’রাজ। হযরত ইয়াকুব আ. সম্পর্কে তাওরাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইয়াকুব আ. বিরে সাকা (সপ্ত কুয়া) হতে বের হলেন এবং হারাম উপত্যকার দিকে রওয়ানা হলেন। সেখানে পৌঁছে একস্থানে শয্যা গ্রহণ করলেন। কেননা, সূর্য অস্ত গিয়েছিল এবং সেখানে তিনি কিছু পাথর মাথার নীচে স্থাপন করেছিলেন এবং তন্দ্রভিভূত হয়ে পড়ে ছিলেন।
এমতাবস্থায় তিনি স্বপ্নে দেখলেন যে, আকাশ হতে জমীন পর্যন্ত একটি সিঁড়ি লাগানো হয়েছে, যার মাধ্যমে ফিরিশতাগণ উঠানামা করছেন এবং এর ওপরে আল্লাহপাক দাঁড়িয়ে আছেন এবং বলছেন, আমি তোমার প্রতিপালক, আমি তোমার স্রষ্টা, ইব্রাহীম ও ইসহাকের স্রষ্টা। তুমি যে ভূখন্ডে ঘুমিয়ে আছ তা তোমাকে এবং তোমার বংশধরদের দান করব। (তাওরাত ; তাকবীন ২৮)। হযরত মূসা আ. তুর পর্বতে সেই সত্য নূরের প্রতিচ্ছবি দর্শন করেছিলেন, সেখানেই তার মি’রাজ সংঘটিত হয়েছিল।
মোটকথা, এই নাতিদীর্ঘ বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে এই যে, সর্বদাই এই সায়েরে মালাকুত আম্বিয়া আ., আল্লাহর মুকাররাব বান্দাহগণ এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জনকারীদের জীবনেতিহাসের একটি অংশ হয়ে আসছে, এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ পদমর্যাদা ও মর্তবা মোতাবেক এই জগতকে মোসাহাদা করেছেন। কোরআন ও সুন্নাহ এই মহামূল্যবান শক্তিকে এতই সহজসাধ্য করে দিয়েছে যে, ঈমানদারেদের জন্য দৈনিক পাঁচবার সেই সায়েরে লাহুতির ও হাগুতির পরিমন্ডলের কোনো না কোনো অংশে বিচরণ করাকে সম্ভাব্য করে তুলেছে। তাই সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে, আস সালাতু মি’রাজু মুমিনীন। অর্থাৎ নামাযই হচ্ছে মুমিনের জন্য মি’রাজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন