করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে সব ধরনের গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল বিকালের পর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে লঞ্চ ও ট্রেন চলাচল। আগামীকাল থেকে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যাবে। এর আগে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামীকাল ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এর পর থেকে ঢাকা ছেড়ে ঘরে ফেরার ধুম পড়ে যায়। গতকাল মঙ্গলবার ভোর থেকে হাজার হাজার মানুষ গ্রামের পথে ছুটতে থাকে। বাস ও লঞ্চ টার্মিনাল ও রেল স্টেশনে হাজার হাজার যাত্রী ভিড় করে। এই মুহূর্তে জনসমাগম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ঘরে ফিরতে গিয়ে মানুষ সে কথা বেমালুম ভুলে গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, গাদাগাদি করে এই যাত্রা নতুন করে বিপদ ডেকে আনতে পারে। কেউ একজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে তার দ্বারা শত শত যাত্রীর মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত ইনকিলাবকে বলেন, ঘরে ফেরার সময় মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে যাচ্ছে এতে একজনের শ্বাসপ্রশাস ও কথা বলার সময় মুখের লালা অন্যের শরীরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এতে করে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি প্রবল।
করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে গতকাল সন্ধ্যার পর থেকে সারাদেশে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। রেলমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন দুপুরে রেল ভবনে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আজ এবং এখন থেকেই সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এখন থেকেই এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকবে। তবে মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে।
এর আগে দুপুর ১২টার দিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। গত মঙ্গলবার রাত থেকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মেইল ও লোকাল ট্রেনের চলাচল বন্ধ করা হয়। তবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকা-জয়দেবপুর পথে কিছু লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চালু ছিল। গতকাল দুপুরে রেলভবনে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন, মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন, রেলের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মো. মিয়াজাহানসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠক করে ২৬ মার্চ থেকে সব যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাৎক্ষণিকভাবে সব যাত্রীবাহী ট্রেন গতকাল থেকেই চলাচল বন্ধের নির্দেশনা আসে। এরপরই তা জানিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে, ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণার আগেই ভোর থেকে হাজার হাজার যাত্রী কমলাপুর স্টেশনে ভিড় করে। টিকিট কাউন্টারের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে থাকে। বেলা যতো বাড়ে ভিড় ততোই বাড়তে থাকে। সকালের দিকে কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে যাওয়া প্রতিটি ট্রেনেই গাদাগাদি করে ওঠেন যাত্রীরা। দুপুরের পর ট্রেন চলাচল বন্ধের ঘোষণা আসার পরও কমলাপুরে যাত্রীদের ভিড় দেখা গেছে। ট্রেনের ভিড়ের ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একজন জামালপুরগামী তিস্তা এক্সপ্রেসের ভিড় নিয়ে লিখেছেন, ‘এটা তিস্তা এক্সপ্রেস নয়, করোনা এক্সপ্রেস’।
রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোতেও ছিল একই চিত্র। সকাল থেকে মহাখালী, সায়েদাবাদ, গাবতলী ও ফুলবাড়ীয়া বাস টার্মিনালে ছিল উপচে পড়া ভিড়। যাত্রীরা দূরপাল্লার বাসের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। টিকিট না পেয়ে অনেকে ছুটোছুটি করতে থাকেন। দুপুরের দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী এক ভিডিওবার্তায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ থাকার ঘোষণা দেন। বার্তায় মন্ত্রী বলেন, দেশের মানুষ, যাত্রীসাধারণ, গাড়ির মালিক শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে, আগামী ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে গণপরিবহন লকডাউন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ওষুধ, জরুরি সেবা, জ্বালানি, পচনশীল পণ্য পরিবহন এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে। পণ্যবাহী যানবাহনে কোনও যাত্রী পরিবহন করা যাবে না।
এই ঘোষণার পর টার্মিনালে যাত্রীর সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। সায়েদাবাদ টার্মিনালে লুৎফর নামে এক যাত্রী বলেন, একদিন পর কিভাবে যাবো? সেজন্য ঝুঁকি নিয়ে আজকেই পরিবার নিয়ে রওনা করেছি। যেভাবেই হোক গ্রামে পৌঁছতে পারলেই হলো।
অন্যদিকে, গতকাল মঙ্গলবার বিকেল থেকে সারাদেশে যাত্রীবাহী সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবিøউটিএ)। আগামী ৪ এপ্রিল পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সচিবালয়ের অফিস থেকে এক ভিডিও বার্তায় এসব তথ্য জানান। প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক মঙ্গলবার থেকে নৌপরিবহন সম্পূর্ণ বন্ধ। লঞ্চ চলাচল করবেনা। যাত্রীবাহি নৌযান চলাচল করবেনা। নিত্যপ্রয়োজনীয় যে সকল দ্রব্য আছে সেগুলো কার্গোর মাধ্যমে পরিবহন করবে। সীমিত আকারে ফেরি চলাচল করবে। ফেরিতে সাধারণ মানুষ পারাপারের ক্ষেত্রে নিষধাজ্ঞা রয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা করোনা ঝুঁকির মধ্যে আছি। সড়ক পথে এ্যাম্বুলেন্সসহ জরুরি যান চলাচলের প্রয়োজন হয়। সেকারণে ফেরি চলাচল সীমিত আকারে চালু রাখছি। এ্যাম্বুলেন্স বা প্রয়োজনীয় যান পারাপারের জন্য ফেরি সীমিত আকারে চলাচল করবে। এ ঘোষণার আগে থেকে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। ভোর থেকেই হাজার হাজার যাত্রী সদরঘাটের পথে রওনা করে। টার্মিনালের ভিতরে-বাইরে মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বিকাল থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকবে এজন্য বিকালের আগে পর্যন্ত প্রতিটি লঞ্চ গাদাগাদি করে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা করে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন