হবে আর হচ্ছে। আজ-কাল-পরশু। করোনাভাইরাস মহামারি দুর্যোগ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। সময়ও দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ চট্টগ্রামে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ, মোকাবেলা, চিকিৎসা এবং সংক্রমিত রোগী সনাক্তকরণ কিট, চিকিৎসক-নার্সদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ সবকিছুই নিছক আশ্বাসের মাঝেই সীমাবদ্ধ। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা তাকিয়ে আছেন ঢাকার শীর্ষ আমলা-কর্তাদের মর্জির দিকে। গতকাল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত এসব আশ্বাসের দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম মরণঘাতি এ ভাইরাস সংক্রমণের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা বেশি। বিশেষজ্ঞগণ তাই বলছেন। অথচ করোনার সংক্রমণ রোধ, পরিস্থিতি মোকাবেলা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং তাঃক্ষণিক চিকিৎসাসহ অপরিহার্য প্রস্তুতি সবকিছুই এখন পর্যন্ত অগোছালো। পদে পদে সমন্বয়ের অভাব।
অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ প্রধান সমুদ্র বন্দর চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি এড়াতে গতকাল থেকে আরও বেশ কিছু সতর্কতামূলক ও প্রস্তুতি ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তার বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে শুরু হয়েছে। বিদেশের বন্দর হয়ে আগত জাহাজের নাবিকদের শো’র পাস (চট্টগ্রাম নগরীতে প্রবেশের পাস) দেয়া বন্ধ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব প্রস্তুতি-প্রক্রিয়ার প্রধান দিক হচ্ছে, কারোনার বৈশি^ক দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য তথা অর্থনৈতিক স্বাথেই চট্টগ্রাম বন্দর কার্যক্রম সার্বক্ষণিক (২৪/৭) সচল রাখার অবস্থান সরকার এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, মূলত পণ্যবাহী জাহাজের সম্ভাব্য কোন বিদেশি ও দেশি নাবিকদের মাধ্যমে যাতে কোনভাবেই সংক্রমণ না ঘটে এরজন্য স্বাস্থ্যগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা, জরুরি সেবাগুলো সচল রাখা হয়েছে। এর খুঁটিনাটি দিকগুলো বন্দর প্রশাসনের কর্মকর্তারা গতকাল আরও দেখভাল এবং সমন্বয় শুরু করেন বলে জানান।
তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর ‘আইএসপিএস কোড’ অনুসরণকারী একটি আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর হিসেবে নিয়ম-বিধি অনুসরণ করছে সার্বিক প্রস্তুতি ও সতর্কতার ক্ষেত্রে। বন্দরে করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে বাড়তি সতর্কতার আওতায় বন্দরের প্রতিটি গেইটে প্রবেশ ও বাইরে যেতে নাবিক-বন্দর ব্যবহারকারী, শ্রমিক-কর্মচারীসহ প্রত্যেকের শরীরের তাপমাত্রা গতকাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে দেখা গেছে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বন্দরে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তাছাড়া বন্দর ভবন এবং হাসপাতালে জরুরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম প্রস্তুত এবং বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এদিকে উচ্চঝুঁকি মোকাবিলায় করোনা সম্পর্কিত চিকিৎসা সেবার লক্ষ্যে ঢাকার বাইরে প্রথমেই চট্টগ্রামে ফৌজদারহাট ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি)-কে পুরোপুরি প্রস্তুত করার আশ্বাস শোনা যায় সপ্তাহ থেকেই। এমনকি গত সপ্তাহ থেকে করোনা সনাক্তকরণ কিট আসার কথা বলা হলেও তা গতকালও আসেনি। তিন জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা থেকে কিট নিয়ে ফেরার কথা ছিল। তারা ফিরেছেন, তবে খালি হাতে। কবে নাগাদ সেই কিট আসবে তাও অনিশ্চিত। তার উপর দেখা দিয়েছে ভিটিএম (ভাইরাল ট্রান্সপোর্ট মিডিয়া) সঙ্কট। এর ফলে করোনা সন্দেহে রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানোও এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম।
চিকিৎসকদের বলতে গেলে এখন চরম অসহায় দশা। স্বাস্থ্য বিভাগের অবস্থা ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। দুর্যোগময় মুহূর্তে এ বেহাল অবস্থা চিকিৎসকসহ সচেতনমহল উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত।
এদিকে ৭০ লাখ মানুষের এ মহানগরী এবং জেলা-মফস্বলেও করোনাভাইরাসে ছোঁয়াচে সংক্রমণের ভীতি-শঙ্কার পাশাপাশি দিনে দিনে জনসচেতনতাও বেড়ে গেছে। নগরীর রাস্তাঘাট, দোকানপাট, গণপরিবহন এমনকি রিকশাওয়ালা, ঠেলাচালক এবং সিকিউরিটি গার্ডদের মুখে মাস্ক এবং হাতে গ্লাভস পড়তে দেখা যাচ্ছে। অনেকের হাতে দেখা যাচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। বেড়েছে সাবান দিয়ে হাত ধোঁয়ার প্রবণতাও। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে গতকাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়কে ওয়াটার ক্যানন থেকে বিøচিং পাউডারযুক্ত পানি ছিটিয়ে করোনা জীবাণুমুক্ত করা হয়। নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন থেকে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করে পুলিশ কমিশনার মাহাবুবর রহমান বলেছেন, জনস্বার্থে এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে উত্তর চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন একটি আবাসিক হলকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন হিসাবে প্রস্তুত করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, চট্টগ্রাম বিভাগে গতকাল পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় বিদেশফেরত ১৩শ ৯২ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগের ১১ জেলায় হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৮ হাজার ৭৭০ জন। গতকাল ১৪ জনসহ কোয়ারেন্টাইন শেষ করে এ পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছেন ২২শ ৮০ জন। গতকাল প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে গেছেন একজন, ছাড়পত্র পেয়েছেন একজন। কোয়ারেন্টাইনে আছেন তিনজন।
চট্টগ্রামে নতুন করে কাউকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়নি। আগে থেকেই হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ৯৭৩ জন। সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, এখনও পর্যন্ত চট্টগ্রামে কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি, কাউকে আইসোলেশনেও নেয়া হয়নি। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে করোনাভাইরাস শনাক্তকারী কিট পৌঁছায়নি জানিয়ে তিনি বলেন, খুব শিগগির কিট পাওয়া গেলে শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু হবে। এখন থেকে সেনাবাহিনী করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টিও দেখবেন জানিয়ে তিনি বলেন, সেখানে তারা দায়িত্ব পালন করবে। আমরা তাদের সহযোগিতা দেব। বিআইটিআইডির যুগ্ম পরিচালক ডা. মামুনুর রশীদ বলেন, কিট না আসায় শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করা যায়নি। তিনিও আশাবাদী খুব শিগগির কিট এসে পৌঁছবে। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিটিএম সঙ্কটের কারণে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় সন্দেহজনক রোগীদের নমুনা পাঠানোর কাজও প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। ভিটিএম মূলত রাসায়নিক তরলসমৃদ্ধ একটি টেস্টটিউব। নমুনা সংগ্রহের পর তা এই টিউবে ভরে পরিবহন করা হয়।
এ পর্যন্ত চট্টগ্রাম থেকে ১৩ জনের নমুনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ৯টি রিপোট পাওয়া গেছে। তার কোনটিতেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়নি। কয়েকজন চিকিৎসক জানান, কিট না আসলে সেখানে শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করা যাবেনা আবার ভিটিএম সঙ্কট না কাটলে এ অঞ্চলের রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায়ও পাঠানো যাবেনা। জরুরি ভিত্তিতে এ ল্যাবটি সচল করারও দাবি করেছেন কয়েকজন চিকিৎসক। করোনা সংক্রমণের আগে থেকেই ফৌজদারহাটের এ পরীক্ষাগারটি সচল করার কথা বলে আসছিলেন স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা। তবে বাস্তবে এখনও পর্যন্ত তার কিছুই হয়নি।
অপরদিকে দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লেও এখনও পর্যন্ত চিকিৎসক-নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। এতে করে চিকিৎসকেরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন। জ্বর, সর্দি আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সম্প্রতি নগরীর একটি ক্লিনিকে নিউমোনিয়া আক্রান্ত এক নারীর মৃত্যুর পর করোনা আতঙ্কে তার চিকিৎসা দানকারী চিকিৎসক ও সেবিকারা কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, পার্সোনাল প্রটেকশান ইক্যুইমেন্ট-পিপিই থাকলে এমন আতঙ্ক থাকতো না।
এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ করোনাভাইরাস সংক্রমণরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত বিদেশ থেকে আগত জাহাজের ৭ হাজার ১৭২ জন নাবিককে জ্বর পরিমাপ, করোনার লক্ষণ পরীক্ষা করা হয়। চীনের বন্দর হয়ে আসা জাহাজকে সমুদ্রভাগে রেখেই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখার নিয়ম চালু রয়েছে। গতকাল বন্দরে প্রবেশকারীদের বাধ্যতামূলক সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং জ্বর পরিমাপ করা হয়। সাধারণ জ্বর থাকায় অনেককে ফিরে যেতে হয়েছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ল্যাবে তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন হ্যান্ড স্যানিটাইজার। বিভিন্ন চিকিৎসা উপকরণ প্রস্তুত রাখা হচ্ছে। আগে থেকেই প্রস্তুত সী-অ্যাম্বুলেন্স এবং সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স। বন্দর হাসপাতালে ৫০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিটও প্রস্তুত। গতকাল বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম এসব দিক পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন. আমদানি ও রফতানি কন্টোইনার দ্রুত ডেলিভারি সচলের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তাছাড়া কারোনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার গাইডলাইন অনুসরণ করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন