আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলের নাম আমরা অনেকেই জানি। নবীযুগের মুনাফেক-সর্দার। মুনাফেকি বলা হয়, মুখে এক কথা বলা আর অন্তরে ভিন্ন কিছু পোষণ করাকে।
মুখে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ বলা, আর অন্তরে কুফরি লালন করা। আল্লাহকে অবিশ্বাস করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর নবী না মানা। তবে এ কথা মুখে আনে না। মুখে তো ঈমান প্রকাশ করে। আল্লাহ ও রাসূলের মহব্বত প্রকাশ করে কিন্তু অন্তরে থাকে কুফরি। আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি দুশমনি। তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যামানায় অনেক মুনাফেক ছিল। এ মুনাফেকদের সর্দার ও নেতা ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের ছেলে ছিল রাসূল সা. এর একনিষ্ঠ সাহাবী। নাম আব্দুল্লাহ। বাবা ছেলে উভয়ের নামই আব্দুল্লাহ। মুনাফেক-সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই যখন মারা গেল তখন হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. রাসূল (সা.) এর কাছে আসলেন। রাসূলের কাছে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমার বাবা আব্দুুল্লাহ ইবনে উবাই আপনার সঙ্গে জীবনে যত অন্যায়-অপরাধ করেছে, আপনি তা আল্লাহর ওয়াস্তে ক্ষমা করে দিন। আমার অনুরোধ হচ্ছে, আপনি আপনার জামা মোবারক দান করুন, তা দিয়ে আমার আব্বাকে কাফন পরাব। আর দয়া করে আপনি তার জানাযা পড়াবেন।
আব্দুল্লাহ রাযি. এর উদ্দেশ্য ছিল রাসূল সা. তার জানাযা পড়ালে দুআ করবেন আর রাসূলের জামা দিয়ে কাফন পরানো হবে, রাসূলের কাছে তো আমি ক্ষমা চেয়েছি-ই অতএব আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।
হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. এর এই অনুরোধের কারণে রাসূল সা. এর মন নরম হয়ে যায়। তিনি তার জামা দিয়ে দেন। এ জামা দিয়ে মুনাফিক সর্দারের কাফন পরানো হয়। রাসূল (সা.) যখন তার জানাযা পড়ানোর জন্য যাচ্ছিলেন তখন হযরত ওমর রাযি. রাসূলের জামা টেনে ধরলেন। হযরত ওমর ফারুক রাযি. রাসূল সা.কে তার জানাযা পড়াতে বারণ করেন। কারণ, সে সারা জীবন ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করেছে। কষ্ট দিয়েছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। এখন তার মৃত্যুর পর আপনি তার জানাযা পড়াবেন, দাফনে শরীক হবেন- তা হতে পারে না।
রাসূল সা. সূরা তাওবার একটি আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করলেন, যাতে বলা হয়েছে, আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন বা না-ই করুন (উভয়ই বরাবর), আপনি যদি তাদের জন্য সত্তরবারও ক্ষমা প্রার্থনা করেন তবুও আল্লাহ কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না।
রাসূল সা. বললেন, আমাকে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা বা না করার এখতিয়ার দেয়া হয়েছে। আমি চাইলে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারি, আবার নাও করতে পারি। আর আমি যদি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জন্য সত্তরবারের বেশি ক্ষমা প্রার্থনা করি আর আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দেন, তা হলে আমি তা-ই করব।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) তার জানাযা পড়ালেন। পরক্ষণেই আয়াত নাযিল হলো। আয়াতের সারমর্ম হলো আপনি কখনো তাদের কারও জানাযা পড়বেন না, তাদের কারও কবরে গিয়ে দাঁড়াবেন না। তারা আল্লাহ ও রাসূলকে অস্বীকার করেছে আর তারা না-ফরমান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।
আল্লাহ পাক এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে মুনাফিকদের জানাযা পড়তে নিষেধ করে দিলেন। এরপর থেকে এ ধরনের মুনাফিকদের জানাযা পড়ানো রাসূল (সা.) এর জন্য নিষেধ হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জানাযা রাসূল সা. পড়িয়েছিলেন তার ছেলের অনুরোধে। যিনি একজন একনিষ্ঠ সাহাবী ছিলেন। আর নবীজি সা. তার জামা তাকে দান করেছিলেন একটি ভিন্ন কারণে। তা হলো, বদরের যুদ্ধে রাসূল (সা.) এর চাচা হযরত আব্বাস রাযি. মুসলমানদের হাতে বন্দী হন।
তিনি তখনো মুসলমান হননি। মুসলমানরা তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে আসে। তখন ছিল শীতের মৌসুম। মদীনাতে এমনিতেই শীত বেশি। আরও বন্দীশালায় নেই অতিরিক্ত পোশাক। হযরত আব্বাস রাযি.ও ছিলেন দীর্ঘদেহী মানুষ। অনেক উঁচু-লম্বা। কারও জামা তার গায়ে লাগত না।
একমাত্র আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের জামাই তার গায়ে লাগতে পারত। তখন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই তার জামা হযরত আব্বাস রাযি.-কে দিয়ে দেয়। তো আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূলের চাচার উপকার করেছে। তার এ উপকারের বদলা রাসূল সা. দুনিয়াতেই দিয়ে দিতে চাইলেন। যেন কেয়ামতের দিন এর কোনো বিনিময় দাবি করতে না পারে আর রাসূলও তার কাছে কোনোভাবে ঋণী না থাকেন।
এ ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝলাম? আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই রাসূল (সা.) এর একনিষ্ঠ সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ রাযি. এর বাবা। তার কাফন পরানো হলো রাসূলের জামা দিয়ে। তার জানাযা পড়ালেন স্বয়ং রাসূল (সা.)। এর পরও সে ক্ষমাপ্রাপ্ত হবে না। আল্লাহপাক তাকে ক্ষমা করবেন না। অতএব আমরা ভেবে দেখি, আসরা যারা দিন-রাত গোনাহে ডুবে থাকি, কোনো বড় বুর্যুগকে দিয়ে জানাযা পড়ালেই আমার গোনাহ মাফ হয়ে যাবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
দুনিয়া থেকে পবিত্র হয়ে না গেলে এ জানাযা কোনো কাজে আসবে না। গোনাহ তার আমলনামায় গোনাহ হিসাবেই থেকে যাবে। খাঁটি তওবা করে যেতে না পারলে শুধু বুর্যুগদের দিয়ে জানাযা পড়ালে, এমনকি কা’বা শরীফের গিলাফ দিয়ে কাফন পরালেও কোনো কাজ হবে না। এভাবে কারও গোনাহ মাফ হয়ে যাওয়ার নিয়ম থাকলে আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সলুলের গোনাহ মাফ হয়ে যেত। স্বয়ং রাসূল (সা.) যার জানাযা পড়িয়েছেন। রাসূলের গায়ের জামা যার শরীরের কাফন হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে!
অতএব, গোনাহ হয়ে গেলে দুনিয়াতেই ক্ষমা করিয়ে নিতে হবে। জীবন একেবারেই ছোট। কখন আমার হায়াত শেষ হবে বলতে পারি না। গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া চাই। কখন কোন গোনাহ হয়ে যায় তার প্রতি খেয়াল রাখি। যবানের দ্বারা কখন কোন গোনাহ হয়, কানের দ্বারা কখন গোনাহ হয়, হাত ও পায়ের দ্বারা কখন গোনাহ হয়ে যায়- এগুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখি। গোনাহমুক্ত থেকে তওবা করে নিষ্পাপ হয়ে ঈমানের সঙ্গে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পারি- সর্বদা এ দুআ করি। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তাওফিক দান করুন। আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন