হযরত আদম (আ.) হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানবজীবন যাত্রার কত যে চড়াই-উৎড়াই, উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাত অতিবাহিত হয়েছে, তার যথার্থ হিসাব কারো জানা আছে বলে মনে হয় না। কেন হয় না, কি জন্য হয় না, সে প্রশ্নের অবতাড়না না করলেও সোজা কথায় যা সহজেই বলা যায় তা হলো, ‘মানুষের মধ্যে মাটি ও সম্পদের লোভ, ক্ষমতাও শক্তির দাপট, অহংকার ও অনিষ্ট সাধনের প্রয়াস, পূর্বযুগে যেমন ছিল তার ক্রমধারা বর্তমানেও একই গতিতে বয়ে চলেছে।
এরই মধ্যে যা কিছু হেরফের হয়েছে বলে মনে হয় তা অবস্থা, অবস্থান, পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিভিন্নতা ছাড়া কিছুই নয়। আগের যুগের দাম্ভিকেরা সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর বলে যেমন আস্ফালন করেছে, ঠিক তেমনই বর্তমান যুগের পরাশক্তিধরেরাও নানা ছলে বলে, কলে কৌশলে একই অভিনেতাসূলভ সুনিপুন অভিনয় করে চলেছে। এই অভিনয়ের শেষ কোথায়, তা-ই বা কে জানে?
সে যাই হোক, সর্বশেষ আসমানীগ্রন্থ আল কোরআন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, (ক) ‘আর তিনিই, আসমানসমূহ ও ভ‚মন্ডল যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন। আর যেখনই তিনি বলবেন, ‘হও’ তখন (সব) হয়ে যাবে। তার কথাই যথার্থ। আর তার জন্যই রয়েছে সেদিনের রাজত্ব, যেদিন শিঙ্গায় ফুঁক দেয়া হবে। তিনি অদৃশ্য ও উপস্থিত (সকল বিষয়ে) পরিজ্ঞাত। এবং তিনি প্রজ্ঞাময়, অধিক অবহিত।’ (সূরা আনয়াম : ৭৩)।
(খ) ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনি মৃত থেকে জীবিতকে বের করেন, এবং জীবিত থেকে মৃতকে বের করেন। তিনিই আল্লাহ, সুতরাং তোমাদের (সৎ পথ হতে) কোথায় ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে?’ (সূরা আনয়াম : ৯৫)।
(গ) ‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সুপ্রতিষ্ঠিত ধারক। তাকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। তার জন্যই রয়েছে আকাশমন্ডলে যা কিছু আছে তা এবং জমীনে যা কিছু আছে তা। কে সে, যে তার অনুমতি ছাড়া তার নিকট সুপারিশ করবে? তিনি জানেন, যা কিছু তাদের সামনে এবং যা কিছু তাদের পেছনে রয়েছে। আর তারা তার জ্ঞানের সামান্য পরিমাণও আয়ত্ত করতে পারে না, তবে, যতখানি তিনি চান। তার সার্বভৌম ক্ষমতা বা কুরসী নভোমন্ডল ও ভ‚মন্ডল পরিব্যাপ্ত করে আছে এবং এ দু’টোর সংরক্ষণ তার জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায় না। আর তিনি সুউচ্চ, সুমহান।’ (সূরা বাকারাহ : ২৫৫)।
(ঘ) ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই; দৃশ্য অদৃশ্যের জ্ঞাতা, তিনিই পরম করুণাময় দয়ালু। তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনিই বাদশাহ, মহাপবিত্র, ত্রæটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহা পরাক্রমশালী, মহা প্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত, তারা যা অংশীদ্বার স্থাপন করে তা হতে তিনি পবিত্র মহান। তিনিই আল্লাহ, সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদানকারী, তার রয়েছে সুন্দর নামসমূহ, নভোমÐলে ও ভ‚মÐলে যা আছে সবই তার মহিমা ঘোষণা করে। তিনি মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা হাশর : ২২-২৪)।
মোটকথা, উপরোল্লিখিত আয়াতে কারীমাসমূহের অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে অতি সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, নিখিল বিশ্বে যা কিছু তার স্থিতি, স্থায়ীত্ব, ক্রমবিকাশ, ক্রমোন্নতী ও নিয়ন্ত্রণ এমন এক শাশ্বত মহান সত্তার দান, যিনি অসীম জ্ঞান-বিচক্ষনতার অধিকারী। যিনি সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। যার হাতে রয়েছে জীবন-মরণের বাগডোর, যিনি এক, অদ্বিতীয়, অনুপম, অবিভায্য, চিরন্তন ও অনিবার্য সত্তা। তিনিই মহান আল্লাহ। বিশ্ব জগতের সৃষ্টি, প্রতিপালক ও শৃঙ্খলা বিধানে তার কোনো শরীক নেই; নেই কোনো সহকারী, সহযোগী। তিনি তার সত্তায় যেমন একক, তেমনি তার গুণাবলীতেও একক, অতুলনীয় ও অনুপম।
আল্লাহপাকই একমাত্র সত্তা যিনি ইবাদত ও বন্দেগি, দাসত্ব, আনুগত্য পাওয়ার উপযুক্ত। তিনিই বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, মরণদাতা, বিধানদাতা। তারই রয়েছে নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব। তার এই সার্বভৌমত্বের মূলে যে বা যারাই আঁচর কাটার পায়তারা করেছে, তিনি তাদের সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় সে সব কাহিনী প্রভাত সূর্যের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। তাইতো বর্তমান বিশ্বের পরাশক্তিধর ও সীমালঙ্ঘনকারী জাতি-গোষ্ঠির ওপর নেমে এসেছে অজানা গজব।
এই গজবের যাঁতাকলে নিস্পেষিত হয়ে কে কখন কোথায় হারিয়ে যাবে, তার ঠিকানা কেউ বলে দিতে পারে না। আর পারে না বলেই আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আল্লাহপাক যখন কোনো বান্দাহ, শ্রেণী, জাতি ও ভ‚মÐলকে ধ্বংস করতে চান, তখন তাদের তিনটি কাজে এমনভাবে লিপ্ত করে দেন, যা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারে না।
যথা : (ক) তাদের ইলম, জ্ঞান দান করেন। কিন্তু তারা এই জ্ঞানের যথাযথ সদ্ব্যবহার করে না। ফলে, তাদের নেক আমল করার তাওফিক লাভের সুযোগ দেয়া হয় না। (খ) তাদের সালেহীন বা সৎলোকের সাহচর্য দান করেন। কিন্তু তারা তাদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রতি মোটেও দৃষ্টিপাত করে না। ফলে, তাদের অন্তরসমূহ তমসাচ্ছন্ন করে দেয়া হয় এবং এই অন্ধকারের ঘূর্ণিপাকে তারা নিঃশেষ হয়ে যায়। (গ) তাদের ভালো কাজের অবকাশ দান করেন। কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থ চিন্তায় এতই বিভোর হয়ে পড়ে যে, তাদের মাঝে সৃষ্টির সেবা করার খেয়াল অবশিষ্ট থাকে না। যার কারণে নিজেদের উৎসমূল ক্রমান্বয়ে শুকিয়ে যেতে থাকে এবং এক সময় ধরাশায়ী হয়ে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন