ঈমানের পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো নামাজ। আর নামাজ আদায় করতে হবে একাগ্রচিত্তে, খুশু-খুজুর সাথে। একবার হযরত হাতেম আসম রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি কিভাবে নামাজ আদায় করেন। তিনি জবাবে বললেন, আমি প্রথম খুব ভালোভাবে ওযূ করে নিই। ওযূর দ্বারা আল্লাহ তাআলা বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সগীরা গোনাহগুলো মাফ করে দেন। এরপর আমি যখন নামাজে দাঁড়াই তখন মনে করি, যেন আমি পুলসিরাতের উপর দাঁড়িয়ে আছি। একটু নড়াচড়া করলেই নিচে জাহান্নামের আগুনে পড়ে যাব। মনে করি, কাবা ঘর আমার সামনে। আমার ডানে জান্নাত আর বামে জাহান্নাম। পেছনে মালাকুল মউত দাঁড়িয়ে আছে। আর মনে করি, এটাই আমার জীবনের শেষ নামাজ।
তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, এভাবে আপনি কতদিন যাবৎ নামাজ আদায় করছেন?
বললেন, ৩০ বছর যাবৎ আমি এভাবেই নামাজ আদায় করে আসছি।
এ কথা শুনে প্রশ্নকারী কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি তো জীবনে এক ওয়াক্ত নামাজও এভাবে আদায় করতে পারিনি।
আমাদের দাদা শায়খ হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. নামাজে ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজু সৃষ্টির পাঁচটি উপায় বর্ণনা করেছেন। এগুলো অবলম্বন করলে একাগ্রচিত্তে পূর্ণ মনোযোগসহ নামাজ আদায় করা সম্ভব।
এক. যারা অর্থ বোঝে তারা অর্থের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রেখে কেরাত পড়বে। প্রতিটি তাকবীর, তাহমীদ, তাসবীহ ও অন্যান্য দুআ পাঠের সময় অর্থের প্রতি লক্ষ রাখবে। এর দ্বারাও মন অন্য কিছুর প্রতি ধাবিত হওয়া থেকে বিরত থাকবে।
দুই. কখনো কোরআনে কারীমের এমন অংশ তেলাওয়াত করা হয় যার অর্থ আমার জানা নেই কিংবা মুসল্লী যদি সাধারণ মানুষ হয় তা হলে এ ক্ষেত্রে নামাযের কেরাত, তাকবীর, তাহমীদ, দুআ ও তাসবীহ পাঠের সময় শব্দের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখবে। উদাহরণত, আল্লাহু আকবার উচ্চারণের সময় প্রতিটি অক্ষর পূর্ণ খেয়াল করে উচ্চারণ করবে। প্রথম হামযা তারপর দুইটি লাম এরপর হা এভাবে প্রতিটি অক্ষর খেয়াল করে উচ্চারণ করবে। অর্থ জানা না থাকলে এভাবে প্রতিটি অক্ষরের প্রতি খেয়াল করে নামাজ আদায় করবে।
তিন. এই ধ্যান-খেয়ালের সাথে নামাজ আদায় করবে যেন আমি আল্লাহ পাককে দেখছি। আমার রব আমার খালেক আল্লাহ তাআলা আমার সামনে রয়েছেন। হাদীসে জিব্রাইলে উল্লেখ রয়েছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, এমনভাবে তুমি ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহ তাআলাকে দেখছ। এটাকে তাসাওউফের পরিভাষায় বলা হয়, ‘মরতবায়ে মুশাহাদা’। এ ধ্যান-খেয়াল জাগ্রত রেখে কেউ নামাজ আদায় করলে তার মন অন্য দিকে যাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা তো আমাদের সর্বদাই দেখছেন। আমাদের সবকিছু তার কাছে একেবারে সুস্পষ্ট। আমার বাহ্যিক সকল কর্মকান্ড তো দেখছেনই এমনকি আমার অন্তর কী কল্পনা করে তাও তিনি জানেন।
হাদীসে ‘তুমি আল্লাহকে দেখছ’ না বলে ‘যেন তুমি আল্লাহকে দেখছ’ বলা হয়েছে। কারণ, আল্লাহ পাককে সরাসরি দেখা সম্ভব নয়; বরং আল্লাহ পাককে দেখার ধ্যান করতে হবে। এই অবস্থা অন্তরে সৃষ্টি করে নামাজ আদায় করতে পারলে ইনশাআল্লাহ নামাজে মন বসবে। কোনো গোলাম মনিবকে দেখতে পেলে সে কি কোনো অন্যায় করতে পারবে? মনিবের নাফরমানি করতে পারবে? কখনোই না।
চার. যদি এ ধ্যান অন্তরে সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়, তা হলে এ কথা খেয়াল করবে, আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন। রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, এমনভাবে তুমি ইবাদত করবে যেন তুমি আল্লাহ তাআলাকে দেখছ। তাঁকে দেখার এ ধ্যান সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে তিনি তো অবশ্যই তোমাকে দেখছেন।
এটাকে তাসাওউফের পরিভাষায় ‘মরতবায়ে মুরাকাবাহ’ বলা হয়। আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখছেন এ ধ্যানে নামাজ আদায় করলে অবশ্যই নামাজে মন বসবে। কোনো গোলাম মনিবকে দেখতে না পেলেও যদি তার জানা থাকে, মনিব তাকে দেখছেন, তা হলে এ অবস্থায় কি তার পক্ষে কোনো অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত হওয়া সম্ভব? এমনিভাবে মুসল্লী যখন ‘আল্লাহ আমাকে দেখছেন’ এ ধ্যানের সঙ্গে নামাজ আদায় করবে তখন তার অন্তরে অন্য কোনো ধ্যান-খেয়াল আসবে না।
পাঁচ. নামাজে দাঁড়ানোর সময় মনে মনে এই খেয়াল করা, হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ নামাজ। এ নামাজের পর আমি হয়তো আর নামাযের সুযোগ পাব না। পরবর্তী নামাজের ওয়াক্ত আসার পূর্বেই আমার মৃত্যু হতে পারে। কেউ নামাজ আদায়ের সময় এই ধ্যান-খেয়াল সৃষ্টি করতে পারলে তার নামাজে ভিন্ন কোনো খেয়াল আসা সম্ভব নয়।
উল্লিখিত পাঁচটির যেকোনো একটি পরিপূর্ণরূপে অবলম্বন করতে পারলে পূর্ণ ধ্যান-খেয়াল ও খুশু-খুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করা সম্ভব হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন