নোভেল করোনা মহামারীতে মৃত ব্যক্তির জানাজা দাফন কাফন নিয়ে আলোচনার অবকাশ তৈরি হয়েছে। নিউইয়র্ক থেকে মুসলমানরা উপমহাদেশের আলেমদের সাথে যোগাযোগ করে মাসআলা জানতে চাইলে এসব নিয়ে নতুন করে আলোচনার সূত্রপাত হয়।
পাকিস্তানের আল্লামা মুফতি তাকি উসমানী সমাধান দিয়েছেন। বাংলাদেশের মুফতিগণও সমস্যার উদ্ভব হওয়ায় জবাব দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করছেন। দারুল উলুম মিশিগান মাদরাসা এ বিষয়ে ভারতীয় মুসলমানদের জন্য দেয়া উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেমগণের একটি ফতওয়া প্রচার করেছে, যা আমাদের সবাইকে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে, শরিয়তের মূলনীতির আলোকে আমরা দেশিয় পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনায় আমাদের মতামতও পেশ করতে পারি।
বিভিন্ন দেশ করোনায় মৃতের দাফনের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে একটি আদেশ জারি করেছে, আদেশে বলা হয়েছে যে মৃত ব্যক্তিকে কোনোরকম স্পর্শ না করে প্লাস্টিকের শীট বা ব্যাগে জড়িয়ে দেয়া হবে। সংস্কৃতি ভেদে লাশকে উচ্চ তাপমাত্রায় পোড়াতে হবে এবং যদি কবর দেয়া হয় তবে খুব ভালো করে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে জনবসতি এলাকা প্রভাবিত না হয়। পাঁচজনের বেশি লোকের জন্য জানাযায় যোগদান না করার নিয়ম বেঁধে দেয়া হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ১. করোনায় কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তাকে কীভাবে গোসল দেয়া উচিত? যদিও এই রোগটি ছোঁয়াচে, গোসল দাতা আক্রান্ত হতে পারে এবং সরকার হাত লাগানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। ২. কিভাবে কাফন পরাবে? কারণ দেহটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে জড়িয়ে আত্মীয়দের হাতে দেয়া হবে? ব্যাগটা খোলা নিষেধ। ৩. মৃতদেহ কবরে নিয়ে যাওয়া কীভাবে? কেউ কেউ বলেছেন যে যারা রোগীকে কবরে নিয়ে যান তারাও এই রোগের শিকার হতে পারেন। ৪. ভারতসহ কিছু দেশের সরকারি আদেশে বলা হয়েছে যে, মাটিতে কবর দেয়া সত্তে¡ও, আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই রোগটি পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলবে, তাই এটি পুড়িয়ে ফেলা উচিত। এই পরিস্থিতিতে শরিয়তের বিধান কি? ৫. কেবল পাঁচ জনকেই জানাজায় অংশ নিতে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে আমাদের কী করা উচিত?
উত্তর : করোনাভাইরাস দ্বারা সংক্রামিত ব্যক্তির কবর দেয়ার বিষয়ে যেসব প্রশ্ন আসছে, সেগুলোর উত্তর নিচে দেয়া হলো। ১. মৃত ব্যক্তিকে গোসল করানো ফরযে কেফায়া। তাই মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা দরকার। গোসলদাতা যদি এই রোগ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন থাকেন তবে মৃত ব্যক্তিকে হাসপাতাল বা অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের লোকেরাই সতর্কতার সাথে গোসল দেবেন ।
যদিও সরকার কর্তৃক বিধিনিষেধ রয়েছে যে, মৃত ব্যক্তিকে হাসপাতাল থেকে বহিষ্কার করার পরে যেন কেউ লাশ না খুলেন, তবে হাসপাতালের কর্মীদের সাথে কথা বলে, কেবল প্যাকিংয়ের আগে (অমুসলিম দেশে) হাসপাতালের একজন মুসলিম কর্মী দ্বারা গোসল দেয়া উচিত। যদি হাসপাতালে কেয়ার স্টাফে কোনও মুসলমান না থাকে, তবে অমুসলিম কর্মচারীকে গোসলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জানিয়ে তাকে দিয়েই করাবে, অনুমতি পাওয়া গেলে সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করে যদি সম্ভব হয় নিজেদের লোকেরা গোসল দেবে।
যদি স্পর্শ করা একেবারে সম্ভব না হয় তবে পাইপ থেকে ঢেলেও মৃত দেহকে গোসল দেয়া যেতে পারে এবং যদি কোনও ক্ষেত্রে গোসল দেয়া সম্ভব না হয় তবে মৃত ব্যক্তিকে প্যাকিংয়ের আগে গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করানো উচিত। যদি তাও সম্ভব না হয়, অপারগ অবস্থায় ব্যান্ডেজের উপরে যেভাবে মাসেহ বা তায়াম্মুম করা জায়েজ, ঠিক তদ্রুপ অপারগ অবস্থায় প্যাক করা লাশের উপরে তায়াম্মুম করা জায়েয।
২. প্লাস্টিকের প্যাকেট অপসারণ করা যদি স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করে বা আইনত নিষিদ্ধ হয় তবে মৃত ব্যক্তির শরীরে যে প্লাস্টিক রয়েছে তা কাফনের মাধ্যমে পেঁচানো উচিত এবং যদি এটি সম্ভব না হয় তবে শরীরের ব্যাগ বা প্লাস্টিকই কাফন হিসেবে বিবেচিত হবে।
৩. সাবধানতা এবং যত্ম সহকারে লাশটি কবরে রাখতে হবে। প্রয়োজনে শরীরে সুরক্ষা পোশাক ও হাতে স্যানিটাইজার ইত্যাদি ব্যবহার করা চাই ।
৪. জীবিত মানুষকে যেভাবে শ্রদ্ধা করা হয়, মৃতদেহের প্রতি সেভাবে শ্রদ্ধা করা কর্তব্য । ইসলামী শরিয়ায় লাশ পোড়ানো মোটেও অনুমোদিত নয়। তাছাড়া জীবাণু নাশে পোড়ানোর চেয়ে উত্তম রূপে দাফন বহুগুণ বেশি নিরাপদ। হ্যাঁ, যদি পরিবেশের ওপর এই রোগের প্রভাব পড়বে এমন সত্যিকারের উদ্বেগ থাকে, তবে মৃত ব্যক্তিকে কবরস্থানের নিরাপদ স্থানে কবর দেয়া উচিত এবং লাশের কাছাকাছি বাঁশের মাচা রেখে কবরটির অধিকাংশ মাটি দিয়ে ভরাট করা উচিত। নতুন পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে যে, করোনাভাইরাসে মৃত্যুর পর লাশ থেকে জীবিত ব্যক্তির ন্যায় ভাইরাস ছড়ায় না। তাছাড়া মাটির নিচে এসব ভাইরাস তিন থেকে চার ঘণ্টার বেশি কর্মক্ষম থাকে না।
৫. জানাজার নামাজ ফরজ, তাই কেবল পাঁচ জন লোক অনুমোদিত হলেও জানাজা অবশ্যই পড়তে হবে। আসল বিষয়টি হলো লাশ সামনে নিয়ে জানাজার নামাজ পড়া। কিন্তু যদি সাবধানতা অবলম্বন জরুরি হয় তবে লাশ থেকে জানাজার দূরত্ব প্রয়োজন পরিমাণ হওয়া উচিত এবং সবাই দূরে দূরে দাঁড়িয়ে হলেও জানাজার নামাজ পড়া উচিত। জরুরি অবস্থায় এম্বুল্যান্স বা গাড়িতে লাশ রেখেও জানাজা হতে পারে।
এ নির্দেশনাটি বৈশ্বিক। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা এখনো পর্যন্ত বলা চলে, এতটা অস্বাভাবিক হয়নি। এ লেখাটি তৈরি করা পর্যন্ত আমাদের জন্য জানাজা দাফন কাফন নিয়ে খুব ভাবনার কারণ দেখা দেয়নি। সুরক্ষা নীতি অনুসরণ করে এবং অল্প মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে মৃত ব্যক্তির সাথে সম্মানজনক উত্তম আচরণ করা সবারই কর্তব্য।
এদেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা ৬ জন হলেও এর উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন এর ৫/৬ গুণ মানুষ। বহু আলেম ও দীনদার মানুষ মোবাইল নম্বর দিয়ে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, জানাজা দাফন কাফন নিয়ে ভাববেন না। খবর দিবেন। আমরা এই খেদমতটুকু করতে চাই।
আল মারকাজুল ইসলামী নতুন গাড়ি বহর ও ভলান্টিয়ার নিয়ে প্রস্তুত। তারা বিজ্ঞাপন দিয়ে আহ্বান জানিয়েছে, তাদের করোনা সঙ্কটে পতিত জনগণের জন্য প্রদত্ত সেবার। সুতরাং বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব দ্রুত পাল্টে না গেলে, ইনশাআল্লাহ এদেশের মানুষকে প্রায় স্বাভাবিক জানাজা দাফন কাফন দিতে সক্ষম হবে এদের আপনজনেরা। পরিস্থিতির পরিবর্তনে মাসআলারও পরিবর্তন আসবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন