বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কৃষকদের সহায়তা করতে হবে

বশিরুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ৬ মে, ২০২০, ১২:০৩ এএম

সারাবিশ্বের মানুষ আজ নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গৃহবন্দি। যেন এক ধাক্কায় বিশ্বের সমস্ত কিছুকে থমকে দিয়েছে। পালটে দিয়েছে সমস্ত কিছুকেই। প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। ভোর হতেই যে শহর জেগে উঠে কোলাহলে, সেই শহর এখন কোলাহলমুক্ত। নেই মানুষের সমাগম। চারদিকে নীরব-নিস্তব্ধ। এমন পরিস্থিতিতে আমি কেন আজ সবাই স্বীকার করছে, আমাদের সামনের দিনগুলো সত্যি বড় চ্যালেঞ্জের। দেখা যাবে, অর্থ আছে কিন্তু পণ্যের অভাব। জরুরি সেবার অল্প সংখ্যক যানবাহনকে মাঝে মধ্যে সড়কে চলাচল করতে দেখা গেলেও গণপরিবহনসহ বন্ধ রয়েছেÑ রেলপথ, আকাশ পথ, নদীপথ। সড়কে চলছে সেনাবাহিনী এবং পুলিশের টহল। অঘোষিত লকডাউন। এ লকডাউন অমান্য করেই দেশের কৃষক ফসল ফলাচ্ছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে মানুষের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। তার বিনিময়ে আমরা কৃষকদের কি দিচ্ছি? এখন সময় এসেছে ভেবে দেখার। একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন- যদি কৃষক একমাস গৃহবন্দি থাকে তাহলে কী হবে? আমিতো মনে করি, দেশে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিবে। এক পযার্য়ের দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে।
কেন এ কথায় বললাম, তার কারণ হচ্ছে, যে দেশে বাজারে একটা মোটামুটি মানের মাস্কের দাম গড়ে ৪০ টাকা। আর ৫২ কেজি ওজনের এক বস্তা শসার দাম পাইকাররা বলছে মাত্র ৩০ টাকা, তাও কিনতে চাইছে না অনেকেই, এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে দিনাজপুরের বীরগঞ্জের শসাচাষিরা। দর নামতে নামতে কেজি প্রতি মোটে ৫০ পয়সা হওয়ায় এক বস্তা শসা বেচেও একটা মাস্ক কিনতে না পারার এমন পরিস্থিতিতে সরকারের নজর দাবি করে দুই শতাধিক কৃষক মানববন্ধন করেছে। উত্তর বঙ্গের প্রবেশদ্বার বগুড়ার সব থেকে বড় সবজি বাজার মহাস্থান হাটে পানির দরে বিক্রি হচ্ছে বেগুন, টমেটো, মূলাসহ বিভিন্ন প্রকারের সবজি। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২ থেকে ৪ টাকা, মূলা ১ টাকা, কাঁচা মরিচ ও করলা ১০ টাকা, শসা ৫ টাকা, টমেটো ৫ থেকে ৬ টাকা, ফুলকপি ৫ টাকা, বাঁধাকপি ৪ টাকা কেজি দরে। পাইকার এবং ক্রেতার অভাবে খেতেই পচতে শুরু করেছে তরমুজ। অপরদিকে সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন খামারে ৫ টাকা লিটার দরে দুধ বিক্রি হচ্ছে। পোল্ট্রি খামারিদেরও মাথায় হাত পড়েছে। ৪০ টাকা কেজি দরেও ক্রেতা পাচ্ছেন না। আর লেয়ার বাচ্চা যেখানে বিক্রি হতো ২০ থেকে ৩০ টাকায় সেখানে তা ফ্রিতে কেউ নিচ্ছে না। এসব বিষয়ে এখনই নজর না দিলে খামারিরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে। বাজারে তার বিরূপ প্রভাব পড়বে শীঘ্রই।
রাজধানীর খুচরা বাজারে আবার ভিন্ন চিত্র। এখানে ভোক্তাকে বেশি টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। প্রতি কেজি টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। অথচ প্রতি কেজি টমেটো কৃষক বিক্রি করছে ৩ থেকে ৫ টাকায়। যদিও কৃষকের প্রতি কেজি টমেটো উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৮ থেকে ১০ টাকা। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা, শসা ২০ টাকা, ফুলকপি ৩০ টাকা, করলা ৪০ টাকা, বরবটি ৪০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, শিম ৪০ টাকা, গাজর ২০ টাকা, মূলা ১৫ টাকা, পটল ৪০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। এসব চিত্র দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, কৃষক সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ তুলতে না পারলেও সুযোগ নিচ্ছে ঠিকই মধ্যস্বত্তভোগীরা। এটা ঠিক কৃষক রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-করোনা উপেক্ষা করে ফসল ফলায় বলেই আমাদের খাদ্যের সংস্থান হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে বাম্পার ফলন ফলিয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে কৃষক তার মাঠের বিনিয়োগ তুলে আনতে পারছে না।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারাদেশে প্রায় সবকিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসময় কৃষি সামগ্রী যেমন বীজ, সার, কীটনাশক কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে এ ব্যপারে দিক-নির্দেশনাও দিয়েছেন। দুর্যোগের এই সময়টাতে সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ ও ডিজেলের দামে প্রত্যক্ষ ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে, কৃষিঋণে সুদ ও কিস্তি আপাতত স্থগিত করা যেতে পারে। মোট কথা যথাসম্ভব উপায়ে কৃষিতে গতি সঞ্চার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমবায় বাজার করে কৃষকের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করার উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে কৃষক ন্যায্যমূল্য পায়। এছাড়া কৃষক যেসব এলাকায় পণ্যামূল্যা পাচ্ছে না এসব এলাকা থেকে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট মূল্যে ক্রয় করে রাজধানীতে বিক্রি করা উদ্যোগ নিতে পারে।
সা¤প্রতিক সময়ে ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করার কারণে মূল্যবৃদ্ধির উদাহরণ আমাদের মনে রাখতে হবে। ২০০৬ হতে ২০০৮ সালে তত্ত¡বধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন দেশের চাল রফতানি বন্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কথাও মনে রাখতে হবে। বৈশ্বিক সংকটের সময় খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলায় জরুরি প্রয়োজনে শত বিলিয়ন ডলারের রির্জাভও কোনো কাজে আসে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, অতীতের সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে যথেষ্ট সফল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’র কৃষি ক্ষেত্রে সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং দিকনির্দেশনায় খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ। কৃষক এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে দেশে চার কোটি টন চাল উৎপাদনের পাশাপাশি আলু, ভুট্টাসহ নানাবিধ ফল ও সবজি উৎপাদনের পাশাপাশি পোল্ট্রি, ডেয়ারি ও মৎস্য উৎপাদনের উপর জোর দেয়ার কারণে কৃষিখাতে বহুমাত্রিক অগ্রগতি হয়েছে।
স¤প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি দূরদর্শী নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দেশের আনাচে কানাচে কোনো জমি যেন খালি না থাকে। যার যা সামর্থ্য তা অনুযায়ী যেনো ফসল ফলাতে মনোযোগী হয়। বাড়ির আঙ্গিনায় বারোমাসী সবজি, আমদানি নির্ভর মসল্লা ও অন্যান্য ফসল ফলায়। যাতে আমদানি নির্ভরতা কমে আসে। যদি প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা সবাই কার্যকর করে তাহলে অন্তত ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এ রমজানে যাতে সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম না বাড়ে সেদিকেও নজর দিতে হবে। করোনাকারণে যেহেতু আমরা গৃহবন্দি, এ সময়টা বাড়ির আঙ্গিনায় কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় সবজি চাষ করতে পারি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা মোকাবিলা-৭২ হাজার ৭শ’ ৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন দেশপ্রেমী রাষ্ট্রনায়ক। অত্যন্ত বিনয়ের সহিত উল্লেখ করতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশবাসীর কাছে কৃষি বান্ধব হিসেবে পরিচিতি। ইতোমধ্যে তিনি কৃষিখাতে প্রণোদনামূলক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন।
করোনাভাইরাসের কারণে দেশের পোল্ট্রি শিল্পে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দেড়মাসে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে জানিয়েছে পোল্ট্রি শিল্পের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল। এই মুহূর্তে যেমন শ্রমজীবী মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা জরুরি, একইভাবে আগামীতে সম্ভাব্য বৈশ্বিক খাদ্য সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি উদ্বৃত্ত খাদ্য রফতানি করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্যের উৎপাদন বৃদ্ধি ও ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে কৃষককে বাঁচানো ও তাঁকে এগিয়ে নেওয়াই হবে সবচেয়ে সময়োপযোগী উদ্যোগ।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন