এই পৃথিবীর বাসিন্দা সকল মানুষ পার্থিব জীবনে ও পারলৌকিক জীবনের সকল অঙ্গনে আল্লাহপাকের অফুরন্ত নেয়ামত ও করুণারাশি দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি দন্ডে, প্রতিটি পলে মানুষ আল্লাহ রাব্বুল আল আমিনের অজস্র নেয়ামত উপভোগ করে চলেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, আখেরাতের জীবনেও রয়েছে উপভোগের অজস্র সম্ভার। মানব দেহের সর্বত্রই এমন কি সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে আল্লাহপাকের করুণার পরশ লেগে আছে।
দেহযন্ত্রের প্রতিটি অংশ তার অনুপম সৃষ্টি কৌশলের স্বাক্ষর বহন করছে। মস্তিষ্ক, চোখ, কান, নাক, জিহ্বা, শ্বাসপ্রণালী, হৃৎপিন্ড, স্নায়ুতন্ত্র রক্ত ও শ্লেষ্মা, তার সৃষ্টি রহস্যের নীরব প্রতিবিম্ব। শুধু মানব দেহই নয়, বরং মহাবিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে তার অফুরন্ত সৃষ্টি। এ সবকিছুই মানব জাতির মঙ্গল, কল্যাণ ও উন্নতির পরিচায়ক হয়ে অবিরাম সেবা করে যাচ্ছে। মোট কথা, মানুষের যা গোচরীভ‚ত এবং যা গোচরীভ‚ত নয়, সবকিছুই আল্লাহর অনুপম নেয়ামত। এই নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা ও শোকর আদায় করা সকল মানুষেরই উচিত। আল কোরআনে মহান রাব্বুল আল আমিন ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা আল্লাহর নেয়ামতরাজি গুনে শেষ করতে পারবে না, আর মানুষ প্রকৃতই জালেম ও অকৃতজ্ঞ।’ (সূরা ইব্রাহিম: আয়াত ৩৪)।
আল্লাহপাক আরো ইরশাদ করেছেন : ‘তোমরা আমার নেয়ামতের শোকর আদায় করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সূরা বাকারাহ : আয়াত ১৫২) এবং রাসূলুল্লাহ (সা.) কে সম্বোধন করে আল্লাহপাক বিশেষভাবে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘সুতরাং তুমি আল্লাহর ইবাদত করো।’ এতে স্পষ্টত: প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় করা একান্ত কর্তব্য।
আরবি শোকর শব্দটার অর্থ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। ব্যবহারিক পরিভাষায় অনুগ্রহ লাভের পর অন্তর, মুখ বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার নামই শোকর। এই শোকর আদায় করতে হয় প্রসন্ন চিত্তে, বিনয় ও নম্রতার সাথে, আল্লাহর নির্দেশিত পন্থা অনুসারে কথা ও কাজের মাধ্যমে। বস্তুত শোকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম সম্পদ। এ সম্পদের মাধ্যমেই মানব-জীবন ফুলে-ফলে, রস-গন্ধে, সুখ ও স্বাচ্ছন্দে পরিপ্লুত হয়ে উঠে। এর দ্বারা যেমন আল্লাহপাকের রেজামন্দি ও খোশনুদি অর্জিত হয়। তেমনি সামাজিক জীবনে, রাষ্ট্রীয় জীবনে ও জীবনযাত্রার সকল অঙ্গনে স্থাপিত হয় স¤প্রীতি, সংহতি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণময় আবহ। যা বিনিময় লাভের পথকে সুগম করে তোলে। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘অতিসত্বর আল্লাহ শোকর আদায়কারীদেরকে প্রতিদান প্রদান করবেন।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৪৪)।
উদারহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, দীর্ঘ একটি মাস সিয়াম সাধনা ত্যাগ ও তিতিক্ষার পরিসমাপ্তিতে আমরা কায়মনে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের দরবারে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি এবং এই আকুতি পেশ করি যে, তাঁর অসীম দয়া ও করুণার ফলেই আমরা সিয়াম সাধনার রহমত, বরকত ও জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তি ও নিষ্কৃতির মতো অমূল্য নেয়ামত লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। যদি তা না হতো, তাহলে ধৈর্য ও সবরের এই তরঙ্গ সঙ্কুল সমুদ্র পাড়ি দেয়া আমাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব হতো না। আর হতো না বলেই তাঁর মহান দরবারে সেজদায় অবনত হয়ে শোকরগুজারি করছি। আল্লাহপাকই সর্বাবস্থায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন।
প্রকৃতপক্ষে একজন মুমিন মুসলমান বান্দা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে যে সকল বিনিময় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের নিকট হতে লাভ করে তা মূলত: আল্লাহপাকের অনুগ্রহ, দয়া, ক্ষমা ও অনুকম্পারই মূর্ত প্রকাশ। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে মানব স¤প্রদায়, তোমরা তোমাদের প্রতি (প্রদত্ত) আল্লাহর নেয়ামত স্মরণ কর, আল্লাহপাক ছাড়া কি কোনো স্রষ্টা আছে? যিনি তোমাদের জমিন ও আসমান থেকে রিজিক প্রদান করেন? তিনি ছাড়া উপাস্য হওয়ার উপযুক্ত কেউ নেই। সুতরাং তোমরা কোথায় পরিচালিত হয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছ? (সূরা ফাতির : আয়াত ৩)।
অন্য এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : ‘আর আল্লাহর রহমতে আপনি কোমল হৃদয় হয়েছেন তাদের প্রতি। তবে যদি আপনি কর্কশ ও কঠোর চিত্তের হতেন, তা হলে তারা আপনার চারপাশ থেকে দূরে সরে যেত। সুতরাং আপনি তাদের মাফ করে দিন। তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন এবং কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। এরপর যখন আপনি দৃঢ় সঙ্কল্প করবেন, তখন আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ওপর ভরসা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৫৯)।
এই আয়াতে কারিমায় সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে, আল্লাহপাক কৃতজ্ঞ ও ভরসাকারী বান্দাদের ভালোবাসেন। যারা এই ভালোবাসা লাবে ধন্য হয়েছেন, তরা প্রকৃতই সৌভাগ্যবান। এতে কোনোই সন্দেহ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন