নিজের জন্মস্থান ইরাকের যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর ৩৩ বছরের মোস্তফা আবদুস সাত্তার বিপজ্জনক নৌকা ভ্রমণে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তুরস্ক থেকে গ্রিসে আসেন। একসময় গ্রিসে তাকে পর্তুগালে পুনর্বাসনের প্রস্তাব দেয়া হয়। দেশটি সম্পর্কে তিনি খুব কমই জানতেন। তবে তিনি অনুসন্ধান করে কিছু পরিচিত বৈশিষ্ট্য খুঁজে পান।
সেগুলি তালিকাভুক্ত করার আগে তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘আমি অনেক প্রচলিত শব্দ পেয়েছি’। এর কিছু খাবারের সাথে সম্পর্কিত, অন্যগুলো শহর বা অঞ্চলের সাথে। তারপর আরবি ‘ইন শা আল্লাহ’ এর অপভ্রংশ ‘অক্সালা’ (উচ্চারণ ওশাল্লাহ) শব্দের প্রচলন দেখতে পেয়েছি। উভয়টির অর্থ ‘আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন’।
আর বিদেশী নয়
খুব অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয় যে, পর্তুগিজ ভাষায় আরবির প্রভাব এখনও পাওয়া যায়। কয়েক শতাব্দী ধরে এই অঞ্চলটিতে আরবিভাষী মুসলমানরা মুর নামে পরিচিত ছিল। অষ্টম শতাব্দীতে মুসলমানরা উত্তর আফ্রিকা থেকে যাত্রা করে এবং এখনকার পর্তুগাল ও স্পেনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। আরবীতে আল-আন্দালুস নামে খ্যাত এই অঞ্চলটি প্রসারিত উমাইয়া সাম্রাজ্যে যোগ দেয় এবং মুসলিম শাসনের অধীনে সমৃদ্ধ হয়। তবে সেই উত্তরাধিকারটি মূলত ক্যাথলিক দেশ ভুলে গেছে।
পর্তুগিজ স্কুলগুলিতে পাঁচ শতাব্দীর মুসলিম শাসনের সংক্ষিপ্তসার অধ্যয়ন করা হয়। পাঠ্যপুস্তকগুলোয় এই অঞ্চলে ক্রুসেডারদের সহায়তায় খ্রিস্টান শাসকদের ‘পুনরায় বিজয়ের’ ওপর বেশি জোর দেয়া হয়। অঞ্চলটিতে ক্রুসেডের সমাপ্তি ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে।
সেই থেকে মুরের বিপরীতে পর্তুগিজ পরিচয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আর মুরদের ঐতিহাসিকভাবে শত্রæ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে। তবে ইতিহাসের এ সংস্করণ বিষয়ে সকলেই একমত নন। এভোরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যযুগীয় ইতিহাসের অধ্যাপক ফিলিওমেনা ব্যারোস ব্যাখ্যা করেন, ‘জনসংখ্যার একটি বড় অংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছে’। গবেষণায় বলা হয়েছে, দশম শতাব্দীর মধ্যে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অর্ধেক জনসংখ্যা ছিল মুসলিম।
ব্যারোসের মতে, উত্তর আফ্রিকা থেকে আগত মুসলমানরা উত্তর ইউরোপ থেকে আসা খ্রিস্টান রাজা ও সেনাবাহিনীর চেয়ে বেশি বিদেশী ছিল না যারা তাদের আগে এবং পরে অঞ্চলটি জয় করেছিল। তিনি বলেন, ‘আইবেরিয়ান উপদ্বীপ জয়লাভ করে চলেছে’। ‘মজার বিষয় হচ্ছে, আমরা রোমান বিজয় বা ভিজিগোথিক বিজয় সম্পর্কে কোন কথা বলি না, আমরা সব সময় বলি ইসলামিক বিজয় সম্পর্কে’। মুসলিম সেনাবাহিনী আসার আগে এই অঞ্চলটিতে জার্মানভিত্তিক ভিসিগথরা শাসন করত। তারা ৪১৮ থেকে ৭১১ এর মধ্যে শাসন করেছিল।
ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান শাসকদের লড়াইয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, কিন্তু মুসলিম সেনাবাহিনীর পরাজয়ের অর্থ পর্তুগালে মুসলিম উপস্থিতির অবসান হয়নি। ‘খ্রিস্টান পুনর্দখলের অর্থ এই নয় যে, মুসলমানরা তাদের দেশে ফিরে গেছে, কারণ এই ভ‚মিটিও তাদের ছিল’। তবে বর্তমানে ১ কোটি ১০ লাখ জনসংখ্যার দশমিক ৫ শতাংশেরও কম মুসলমান এবং তাদের কিছু সংখ্যকই মাত্র জানেন যে, মুসলমানরা একসময় জনসংখ্যার অনেক বড় অংশ ছিল।
৩০ বছরের নূর-আইন সাকুর বলেন, ‘স্কুলে যা শেখানো হয় তা সর্বদা [বিজয়ীদের] দৃষ্টিকোণ থেকে শেখানো হয়’। ভারতীয় এবং আরব বংশোদ্ভ‚ত পিতামাতা ওরসে পর্তুগালে জন্ম নেয়া সাকুর লিসবনের মুসলিম স¤প্রদায়ের সদস্য। তিনি স্কুল পাঠ্যক্রমে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের মধ্যে দীর্ঘকালীন সহাবস্থানকে আরও ভালভাবে উপস্থাপন করা পছন্দ করেন।
বিশ্বাস করা হয় যে, এই অঞ্চলটি সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, মুসলিম শাসনের ঐতিহ্যগুলোর প্রতি আরও মনোনিবেশ করা উচিত, এটি পর্তুগালে খুব একটা সুপরিচিত নয়’।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন