হিজরী দ্বিতীয়বর্ষে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের যে বিজয়ের সূচনা হয় অষ্টম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে তা চূড়ান্তরূপ লাভ করে। বদরের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সা.) ১২ রমজান মদীনা হতে যাত্রা করেন এবং ১৭ রমজান বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আর ২০ রমজান রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কায় প্রবেশ করেন। এর পূর্ণ বিবরণ মুসলিম শরীফে হজরত আবু হোরায়রা (রা.)-এর বরাত দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। বায়তুল্লাহ শরীফে প্রবেশকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর হাওদা জান্নাতুল মোয়াল্লা নামক স্থানে রাখা হয়। এখানেই পরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যা মসজিদে ফাতাহ বা বিজয় মসজিদ নামে পরিচিত। এই জান্নাতুল মোয়াল্লায় উম্মুল মোমেনীন হজরত খাদীজাতুল কোবরা (রা.)-কে দাফন করা হয়। এই স্থানে পতাকা স্থাপন করে রাসূলুল্লাহ (সা.) বায়তুল্লাহ শরীফের দিকে অগ্রসর হন। তাঁর অগ্র-পশ্চাতে মোহাজের ও আনসারগণের বিশেষ দল ছিল।
মসজিদে হারামে প্রবেশ করে প্রথমে রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘হাজরে আসওয়াদ’ (কালোপাথর) চুম্বন করেন। অতঃপর তিনি সাওয়ারীর ওপর বসে তওয়াফ করেন, এই সময় তাঁর হাতে তীর ছিল এবং বায়তুল্লাহ শরীফের চতুর্দিকে ৩৬০টি মূর্তি স্থাপিত ছিল। তিনি হাতের তীর দ্বারা মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করতে থাকেন এবং বলতে থাকেন, ‘জা আলহক্কু ওয়াজাহাকাল বাতিলু, ইন্নাল বাতেলা কানা জাহুকা।’ অর্থাৎ ‘সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে, নিশ্চয়ই মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল।’
রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা বনি ইসলাইলের এ আয়াতটি পাঠ করতে থাকেন এবং মূর্তির পিঠের দিকে তীর দ্বারা ইশারা করার সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিও মুখ থুবড়ে পতিত হতে থাকে। আর যখন তিনি মূর্তির সম্মুখ দিকে ইশারা করতে থাকেন, মূর্তি চিত হয়ে পতিত হয়ে যেতে থাকে। কোনো কোনো বর্ণনা হতে জানা যায় যে, মক্কার অপরাপর বড় বড় মূর্তি ধ্বংস করা হয়। ছাফা পর্বতে ‘এসাফ’ এবং মারওয়া পবর্তে ‘নায়েলা’ নামক দু’টি প্রাচীন মূর্তি স্থাপিত ছিল। এই মূর্তিগুলো সম্পর্কে কোরেশদের বিশ্বাস ছিল, এই দু’টি জুরহুম জাতির নারী ও পুরুষ মূর্তি ছিল এবং বায়তুল্লাহ শরীফে জেনায় (ব্যভিচারে) লিপ্ত হয়েছিল। এ কারণে এগুলো বিকৃত করে দেয়া হয়। এই বিশ্বাস থাকা সত্তে¡ও কোরেশরা এগুলোর পূজা করত।
মক্কায় ‘হোবল’ নামক এক মস্তবড় মূর্তি ছিল। এটি যখন ধ্বংস করা হয় তখন হজরত জোবাইর ইবনুল আওয়াম (রা.) আবু সুফিয়ানের উদ্দেশে বললেন যে, ‘এই তথাকথিত মাবুদের প্রতি তোমার এতই গর্ব ছিল যে, ওহুদ দিবসে তুমি বলেছিলে, ‘উলু হোবল’ অর্থাৎ হোবল জিন্দাবাদ।’ এ কথা শুনে আবু সুফিয়ান লজ্জিত হয়ে বলেন, ‘এখন সেই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করো না এবং সেই ধারণার প্রতি আমাদের তিরস্কার করো না। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, মোহাম্মদ (সা.)-এর খোদা ব্যতীত যদি আর কোনো মা’বুদ থাকত, তাহলে তা আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসত। আর আজ অবস্থা হতো ভিন্ন।’ কা’বার দেয়ালে যেসব মূর্তি ছিল এবং সেখানে হাত পৌঁছত না, সেগুলো ধ্বংস করার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে তাঁর কাঁধে সওয়ার করেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) সেগুলো ভেঙে নিচে পতিত করেন।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তওয়াফ সমাপ্ত করার পর হজরত উসমান ইবনে তালহা (রা.)-কে ডাকেন এবং তাঁর কাছ থেকে কাবার চাবি নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করেন। তখন দেখেন যে, হজরত ইব্রাহীম (আ.) ও হজরত ইসমাঈল (আ.)-এর মূর্তি স্থাপন করে রাখা হয়েছে এবং তাঁদের হাতে জুয়া খেলার তীর ধারণ করা। হুজুর (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ এসব কাফেরকে ধ্বংস করুন, এ দু’জন হচ্ছেন মহান নবী, তাঁরা কখনও জুয়া খেলেননি।’ তিনি আরো অবলোকন করেন যে, কাঠের তৈরি দু’টি কবুতর। হুজুর (সা.) স্বহস্তে ওগুলো ভেঙে ফেলেন, ছবিগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দান করেন এবং সেগুলো তখনই ধ্বংস করে দেয়া হয়।
ভীষণ ভিড়ের কারণে রাসূলুল্লাহ (সা:) বায়তুল্লাহ শরীফের দরজা বন্ধ করে দেন। তাঁর সঙ্গে হজরত বেলাল (রা.) এবং হজরত ওসামা (রা.) থেকে যান। অতঃপর দরজার সামনের দিকের দেয়ালের কাছে গমন করে রাসূলুল্লাহ (সা.) তিন হাত দূরে থেমে যান এবং সেখানে নামাজ আদায় করার পর বায়তুল্লাহ শরীফের বিভিন্ন দিক ঘুরে দেখেন এবং সবদিকে তওহীদ ও তকবীর ধ্বনি বুলন্দ করেন, এরপর দরজা খোলেন। কোরেশদের দ্বারা মসজিদ ভরে যায় এবং তারা কাতার ঠিক করে অপেক্ষা করতে থাকে। হুজুর (সা.) দরজায় দাঁড়িয়ে তার দুই বাহু ধরে বলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ওয়াহদাহু, লা শারীকালাহু, ...।’ অর্থাৎ একক আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো মাবুদ নেই, তাঁর কোনো অংশীদার নেই, তিনি তাঁর সত্য প্রমাণিত করেছেন এবং তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সকল দলকে পরাজিত করেছেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি খুতবা পাঠ করেন এবং কোনো কোনো জাহেলী রীতি-নীতি ও প্রথা সম্পর্কে ঘোষণা করেন যে, আজ এ সমস্ত রহিত হয়ে গেল এবং এগুলো আমার পদতলে। এই ভাষণে তিনি আরো বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা.) উপস্থিত সকলের উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, ‘হে কোরেশ! তোমাদের কি ধারণা যে, আমি তোমাদের সঙ্গে কিরূপ আচরণ করব’? সকলে বলে উঠে, ‘উত্তম, আপনি স্বয়ং করিম, দয়ালু করিমের বংশধর। তাই আপনার নিকট আমরা উত্তমই প্রত্যাশা করি।’ হুজুর (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদের কাছে সে কথাই বলতে চাই, যা হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘লা তাসরীবা আলাইকুমুল ইয়াওমা’ অর্থাৎ আজ তোমাদের প্রতি কোনোই অভিযোগ নেই, যাও তোমরা মুক্ত।’
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন