মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪৩০, ০৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

কোরবানির পশু নিয়ে দুশ্চিন্তায় খামারিরা

আতিক সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ২ জুলাই, ২০২০, ১২:০৫ এএম

আসছে ঈদ উল আযহা। আমরা সাধারণত: এই ঈদকে কোরবানির ঈদ বলে থাকি। ঈদ উল ফেতর থেকে ঈদ উল আযহার আয়োজন, ধর্মীয় আচার ও তাৎপর্য ভিন্ন। ধর্মীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সামাজিক সিদ্ধান্তে ঈদ উল ফেতরের চেয়ে বেশ খানিকটা আগেই ঈদ উল আযহার নামাজ সেরে ফেলা হয়। নামাজ শেষে শুরু হয় পশু কোরবানি। আমাদের দেশের মানুষ গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ইত্যাদি কোরবানির পশু হিসেবে জবেহ করে থাকে। এ সব পশুর মধ্যে গরু ও ছাগল সহজলভ্য হওয়ায় বেশি কোরবানি হয়ে থাকে। যে সব মুসলিম কোরবানি দেয়ার নিয়্যত করেন তারা আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন অনেক আগে থেকেই। একইভাবে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেশে অনেক মানুষ রয়েছে যারা বাড়তি একটু আয়ের আশায় গরু-ছাগল লালন-পালন অথবা মোটাতাজাকরণ করে থাকে। দু’দশটি গরুর মাঝে দু’একটি করে ষাড় খৈল-ভূষি খাইয়ে অনেক কষ্টে ও যত্নে লালন-পালন করে থাকে দেশের অনেক কৃষক। ঈদকে ঘিরে এটি হচ্ছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের বাড়তি আয়ের একটি বড় উৎস। এই গরুর আয় থেকে এদের রয়েছে সংসারের জন্য নানা চিন্তা ভাবনা। আবার মাঝারি ও বড় মাপের কৃষক ও খামারি গরু মোটাতাজাকরণ করছে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে। তাদের লক্ষ্য সারা বছরের একটা আয় বা মুনাফা করবে কোরবানির ঈদ থেকে। সেভাবেই মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছে কোরবানির ঈদকে ঘিরে তারা। এসব কৃষক, খামারি তাদের মোটাতাজাকরণ করা পশু বিক্রি নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে রীতিমত। তাদের ধারণা করোনা পরিস্থিতি ঈদ পর্যন্ত গড়ালে পশু বিক্রি হবে না। সঠিক দাম পাওয়া যাবে না। আর এ কারণেই মোটা অংকের লোকসান গুণতে হবে তাদের।

ঈদের উৎসব বা আনন্দ ঈদ উল আযহায় যে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে সেটি হচ্ছে, ত্যাগ। এই ত্যাগ সম্পর্কে আমরা জানি, হযরত ইব্রাহীম (আ.) মহান আল্লাহ তা’আলার আদেশ পালনে প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাইল(আ.)কে তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতিতে কোরবানি করতে উদ্যত হন। মক্কা নগরীর মীনা নামক স্থানে এই কোরবানির উদ্যোগ নেন হযরত ইব্রাহীম (আ.)। মহান আল্লাহ তা’আলা হযরত ইব্রহীম (আ.) আদেশ পালনে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় সন্তুষ্ট হয়ে তার পুত্রের স্থলে একটি পশু কোরবানির নির্দেশ দেন। মহান আল্লাহ তা’আলার ওপর গভীর আনুগত্য ও নজীরবিহীন এই ঘটনার জন্য মীনায় এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের মুসলমান আত্মত্যাগের এই মহান কীর্তি কোরবানিকে ধর্মীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হিসেবে পালন করে আসছে সেই থেকে।

এবারের কোরবানির ঈদ এসেছে এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। অদৃশ্য এই করোনাভইরাস সারা বিশ্বে মহামারি দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। করোনাভাইরাসে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি এখন টালমাটাল। দিন দিন মৃত্যুর দীর্ঘ মিছিল আতঙ্কিত করে তুলেছে বিশ্ববাসীকে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে হু হু করে দেশে দেশে। আমাদের দেশে। একমাত্র সরকারি চাকুরে ছাড়া আর্থিকভাবে ভালো নেই কেউ। আর্থিক সংকটে আক্রান্তের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে অর্থ উপার্জনে ছুটছে বেকার ও নতুন করে বেকার হওয়া হাজারো কর্মহীন মানুষ। মিল, কল-কারখানা নানা প্রতিষ্ঠা একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুনতাম কর্মের সন্ধানে মানুষ ঢাকায় যায়, অথচ এখন ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে কর্মহীন হয়ে লাখো নারী-পুরুষ।

করোনার ভয়াল এ দুর্যোগে কোরবানির পশু নিয়ে খামারিদের দুর্ভাবনার শেষ নেই। তাদের শঙ্কা পশুর দাম পাওয়া যাবে কিনা। হাটে তাদের নিরাপত্তা থাকবে কিনা। ক্রেতার সামর্থ্য বিবেচনায় বড় ষাড়ের কাটতি কেমন হবে। এইসব নানা দুশ্চিন্তা তাদেরকে বিচলিত করছে। তাদের ধারণা, অবলা পশুর দাম না পেয়ে বাড়িতে ফেরত আনলে সাধারণত চাহিদা কমে যায়। তাদের ভাষায়, বিক্রিতে খৈল-ভূষির দাম উঠবে না। পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার সিলন্দা গ্রামের কৃষক নাজিম উদ্দীন জানান, প্রতি বছর আমি একটি দু’টি করে ষাড় মোটাতাজা করি কোরবানি ঈদের অপেক্ষায়। যদি কোরবানির ঈদে বিক্রি না হয় অথবা কম দামে বিক্রি করতে হয় তাহলে প্রচুর লস যাবে আমার। একই উপজেলার আটিয়াপাড়া গ্রামের কৃষক জারমান জানায়, ঈদে ক’টা পয়সা ধরার জন্য এ বছর সে ৩টি ষাড় মোটাতাজা করেছে। এ কৃষক জানান, করোনার এমন পরিস্থিতি ঈদ পর্যন্ত গড়ালে তার আর দুঃখের সীমা থাকবে না। শাহজাদপুর পৌর সদরের দ্বাবাড়িয়া গ্রামের কৃষক রহম আলী জানায়, ঈদের হাটে ষাড় বিক্রি করে খৈল-ভূষির মহাজনের হালখাতা করবে সে। ভালো দাম পাবে এমন আশায় চলনবিল অঞ্চলের বেশ কিছু বেপারি আছে যারা নগদে এবং বাকীতে আবার অনেকে দাদনে পশুকে ঢাকায় নিয়ে যায়। তারা এবার হাটে গরু নিতে বিড়ম্বনায় পড়বে এমন ধারণা নিয়ে বসে আছে। তবে এ কথাও ঠিক যে গরুর হাটের বাস্তবতায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কঠিন। সে যাই হোক, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। এ দিকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এবার সিটিতে ২৩টি হাট বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনেই পশুর হাট বসবে। পশুর হাটে ভিড় এড়ানোর জন্য এক দুইদিন আগে তাড়াহুড়ো করে পশু না কিনে সময় নিয়ে কিনতে বলা হয়েছে। ঢাকার বাইরে এটি করা সম্ভব হলেও হতে পারে। ঢাকায় বাসাবাড়িতে থাকা মানুষ জনের পক্ষে এটা খানিকটা অসম্ভব। হাটে প্রবেশের সময় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সামাজিক দূরত্ববজায় রেখে হাটে ঢোকা এবং বের হওয়ার কথা বলেছে মন্ত্রণালয়। কথায় আছে, গরুর হাটকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা কঠিন। তারপরও বাঁচতে হলে করতেই হবে। তবে এতোসব নিয়ম নিয়ন্ত্রণকে বেশিরভাগ কম শিক্ষিত খামারি ও ব্যবসায়ীরা দেখছে শঙ্কিত চোখে।

করোনা আক্রান্তে মৃতের সংখ্যা যখন আশংকাজনক হারে বাড়ছে তখন কোরবানির ঈদকে ঘিরে খামারি-ব্যবসাীদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। করোনার বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে নেমেছে সবাই। যদিও চিকিৎসা নেই, প্রতিষেধক নেই। এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই এখন ভাবছে সবাই। শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. মিজানুর রহমান জানান, করোনা আতঙ্কে এবং সরকারি নির্দেশনায় মানুষ যেহেতু বাজারে কম আসছে এ জন্যই দুধ এবং মাংসের চাহিদা কিছুটা কমেছে। একই কারণে কৃষক ও খামারি ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরও জানান, শাহজাদপুরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ গরু রয়েছে। আর খামার রয়েছে প্রায় ১১ হাজার। সামনে কোরবানির হাট বিক্রির জন্য রাখা ষাড়কে বাড়তি যোগান দিতে হচ্ছে কৃষককে। শাহজাদপুর উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা মিলে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি ছোট বড় গো-খামার রয়েছে। তিনি আরো যা বলেন, করোনার প্রভাবে বাজারে দুধ ও মাংসের চাহিদা কমে গেছে। মিল্কভিটার সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলায় তাদের আওতায় ৭’শ ১৩টি প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে প্রতিদিন আড়াই লাখ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ সব সমিতি থেকে বাঘাবাড়ী কারখানায় প্রতিদিন পৌনে ২ লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। মিল্কভিটার প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির কেন্দ্রীয় ইউনিয়ন এর আওতায় তাদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫৫ হাজার। এসব সদস্যরা দিনে দু’বার সমিতিকে দুধের যোগান দেয়, দুধে বিদ্যমান ফ্যাট ও অন্যান্য উপাদানের অনুপাতেই দুধের দাম সাধারণত নির্ধারিত হয়। সমিতিতে সংগৃহীত দুধ প্রাথমিক প্রসেসিংয়ের জন্য নিকটতম কারখানায় পৌঁছানো হয়। টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, টেকেরহাট ও শ্রীনগর অঞ্চলের দুধ ঢাকায় আসে এবং তা থেকে তরল দুধ, ক্রিম, আইসক্রিম ও দই প্রস্তুত করা হয়। রংপুর ও বাঘাবাড়ি ঘাটের দুধ থেকে বাঘাবাড়িঘাটের ডেইরি কারখানা গুঁড়াদুধ, মাখন ও ঘি উৎপাদন করে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ করে দুগ্ধ উন্নয়ন খাতে পশু সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গবাদী পশুই আমাদের দেশে দুধ, মাংস, চামড়া প্রভৃতি উৎপাদনের একমাত্র উৎস।
লেখক: সাংবাদিক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন