সারাদেশে এখন অনেক গরম। এর মধ্যে মাঝে মাঝে খানিকটা বৃষ্টির দেখা মিললেও শেষ পর্যন্ত গরম কমছে না। বাতাসে অস্বাভাবিক আর্দ্রতা, সারাদিন কাঠফাটা রোদ। সব মিলিয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ। তীব্র গরমে করোনার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা ও রোগব্যাধি বাড়ছে, অন্যান্য বছরও দেখা গেছে, গরমের সময়ই মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা বেশি দেখা দেয়। তাই এ সময়ে সতর্ক হয়ে না চললে যেকোনো সময়ই আপনি অসুস্থ হয়ে পরতে পারেন। গরমে সাধারণত যেসব স্বাস্থ্যসমস্যা দেখা দিতে পারে তা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা -
গরমে শিশুদের জন্য বিশেষ সাবধানতা :
এই গরমে শিশুদের স্বাস্থ্যের দিকটি বিশেষভাবে ভাবতে হবে। শিশুদের জন্য বাইরের খাবার যথাসম্ভব এড়িয়ে ঘরে তৈরি টাটকা খাবার খাওয়াতে হবে। শিশুদের প্রতিদিন অন্তত চার থেকে ছয়বার প্রস্রাব হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। যদি কম হয়, সে ক্ষেত্রে পানি বা তরল খাবার বাড়িয়ে দিতে হবে। গায়ে র্যাশ ও ঘামাচি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বিশেষ ওষুধের দরকার নেই। ঘাম হলে সঙ্গে সঙ্গে মুছে দিতে হবে এবং ঠান্ডা বা নিরাপদ পরিবেশে শিশুকে রাখতে হবে। প্রতিদিন গোসল ও দিনে দুই থেকে তিনবার শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। এসময়ে নবজাতক ও ছয় মাসের কম বয়সী শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে হবে। নবজাতকদের জন্য বুকের দুধ বারবার দিতে হবে। নরম ও পাতলা কাপড় পরাতে হবে।
গরমে বয়স্কদেরও প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা ঃ
এই গরমে বয়স্ক ব্যক্তিদেরও প্রয়োজন বাড়তি যত্নের। কারণ বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে বেশীরভাগই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত যেমন - ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, এ্যজমা বা হাপানি রোগ, আথ্রাইটিস জনিত ব্যথা-বেদনা ইত্যাদি। তাছাড়াও প্রচন্ড গরমে বয়স্ক ব্যক্তিদের আরও যে সমস্যা দেখা দিতে পারে - শরীরের পানিস্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন, হিটস্ট্রোক, হজমের সমস্যা, ত্বকের সমস্যা ইত্যাদি।
পানিস্বল্পতা বা ডিহাইড্রেশন ঃ
গরমের কারণে সবচেয়ে বেশি যে সমস্যা হয়, তা হলো পানিস্বল্পতা । প্রচুর ঘামের কারণে পানির সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে প্রয়োজনীয় লবণ ও পানি বেরিয়ে যায়। ফলে শরীরের রক্তচাপ কমে যায়, দুর্বল লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে। পানিস্বল্পতা গরমে সাধারণ সমস্যা হলেও অবহেলা করলে তা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি, যারা বাইরে কাজ করেন, প্রয়োজনমতো পানি পান করার সুযোগ পান না, তারাই মারাত্মক পানিস্বল্পতায় আক্রান্ত হয়। এ সময়ে শরীরের কোষ সজীব রাখতে প্রচুর পানি খেতে হবে। ইলেকট্রোলাইটসের অভাব প‚রণ করতে খাবার স্যালাইন খাওয়া যেতে পারে। পানির সাথে অন্যান্য তরল যেমন ডাবের পানি, ফলের রস খাওয়া যেতে পারে।
গরমে আরও কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে যেমন - প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে না যাওয়া ও যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকতে হবে। বাইরে বের হলে সরাসরি রোদ যত সম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে টুপি বা ছাতা ব্যবহার করতে হবে। পরনের কাপড় হতে হবে হালকা, ঢিলেঢালা, সুতির। প্রয়োজনমতো গোসল করতে হবে এবং শরীর ঘাম ও ময়লামুক্ত রাখতে হবে।
হিট স্ট্রোক :
প্রচন্ড দাবদাহে যেসব স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি হয় হিট স্ট্রোক তার অন্যতম। এটি একটি জরুরি মেডিক্যাল অবস্থা। এতে দ্রুত ও সঠিকভাবে চিকিৎসা না করালে মৃত্যুও হতে পারে।
মানবদেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই তাপমাত্রা যদি ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হয়ে যায় তখন মারাত্মক হিট স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে। সাধারণত চার বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে বৃদ্ধরা; যাদের গরম সহনীয় ক্ষমতা কম, যারা কিডনি, হার্ট, লিভার, ডায়াবেটিকের রোগী, যথেষ্ট পানি পান করে না এমন লোকজনের এমনটা হতে পারে। অথবা যাদের শরীর খুব দুর্বল, ক্রীড়াবিদ, ব্যায়ামবিদ এবং প্রচন্ড রোদে কাজ করেন এমন লোকেরা, যাদের ওজন বেশি বা অনেক কম তারা হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হতে পারেন।
কেউ হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির তাপমাত্রা কমাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তিকে শুইয়ে, পা উঁচু করে দিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে এনে বা ফ্যান ছেড়ে শীতল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। থার্মোমিটার দিয়ে বারবার তাপমাত্রা মাপতে হবে এবং শরীরের তাপমাত্রা ১০১-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে না আসা পর্যন্ত ঠান্ডা দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে। তবে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে দ্রুত স্থানীয় হাসপাতালে নিতে হবে।
পেটের অসুখ ও খাবারদাবার :
গরমে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারেও সাবধানতা দরকার। কারণ গরমে খাবার সমস্যা থেকে অনেকে পেটের সমস্যায় ভোগেন। সাধারন খাবার যেমন - ভাত, ডাল, সবজি, মাছ ইত্যাদি খাওয়াই ভালো। বেশি মসলাযুক্ত খাবার ও রাস্তায় বিক্রি হওয়া খোলা খাবার এড়িয়ে চলুন। খাবার যেন টাটকা হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। গরমের সময় খাবার তাড়াতাড়ি পচে যায় বা খাবারে বিষক্রিয়া হয়। সেই খাবার খেলে ফুড পয়জনিং হতে পারে। যা থেকে বমি কিংবা ডায়রিয়া হতে পারে। এই পরিস্তিতিতে ডিহাইড্রেশন কিংবা ব্লাড-প্রেসার কমে যেতে পারে। তাই বাড়ীতে তৈরি টাটকা খাবার খাওয়াটাই ভাল। ফলের এই মৌসুমে ভেজাল, নকল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মিশ্রিত ফলমুল বাজারে থাকে। এসব থেকেও সাবধান হতে হবে। কেননা এগুলো খেলে পেটের পীড়া, লিভারের ক্ষতি, ডায়রিয়া, হার্টে রক্তসঞ্চালনে সমস্যা, কিডনির ক্ষতি, চর্মরোগ এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে।
তাছাড়াও গরমের সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা যায় শরবত ব্যবসায়ীরা রাস্তাঘাটে লেবুসহ নানা জিনিস দিয়ে শরবত বানিয়ে বিক্রি করছেন। যার স্বাস্থ্যমান ও পরিচ্ছন্নতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গরমে স্বস্তি দেবে ভেবে রাস্তাঘাটের এই খোলা শরবত খাওয়া মোটেও ঠিক নয়। কারন এসবে ব্যবহৃত পানি ফুটানো হয় না বলে তাতে থাকা জীবাণুর কারণে ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা হতে পারে। আর কারো ডায়রিয়া হলে বারবার সালাইন, ডাবের পানি খাওয়াতে হবে। কোনো কিছু খাওয়ার আগে অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
এ্যাজমা বা হাপানীর সমস্যাঃ
গরমে অতিরিক্ত ঘাম থেকে ঠান্ডা, সর্দি-কাশি ইত্যাদি দেখা দেয় যা হাপানীতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শ্বাসকষ্ঠ বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই প্রচন্ড রোদ গরম থেকে হাপানীতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের তুলনামুলক ঠান্ডা আবহাওয়ায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। ঘেমে গেলে দ্রুত ঘাম মুছে দিতে হবে।
উচ্চ রক্তচাপ জনীত সমস্যা ঃ
প্রচন্ড গরমে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের রক্তের চাপ বা ব্লাড প্রেসার আরও বেড়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। তাই এই সময়ে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। যেমন - প্রেসার এর ঔষধ নিয়মিত খাওয়াতে হবে। তৈলাক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। আলাদা লবণ খাওয়ানো যাবে না। প্রচন্ড রোদে হাঁটা হাটি করা যাবে না। মানসিক চাপ মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
ডায়বেটিস জনীত সমস্যা ঃ
ডায়বেটিস আক্রান্ত রোগীদের নিয়মিত হাটা খুব জরুরী। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে তীব্র রোদের মধ্যে যেন হাটতে না যায়। কারণ ঘেমে একদিকে যেমন পানি শুন্যতা অন্যদিকে তেমনী রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে যেতে পারে। ফলে ডায়বেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় ট্রানজিয়েন্ট ইসক্রোমিক এট্যাক হতে পারে। তাই সকালে ও সন্ধ্যায় যখন রোদ না থাকে তখন হাঁটতে হবে এবং ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
ত্বকের সমস্যাঃ
প্রখর রোদে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সময়ে খোলা আকাশের নিচে হাঁটাচলা বেশি হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ত্বক ভেদ করে কোষের জন্য বিপদ ডেকে আনে। ত্বকে ফোসকা পড়াসহ ত্বক বিবর্ণ হতে পারে। মেয়েদের ঠোঁটের রং পরিবর্তন হতে পারে। কারো কারো ঠোঁট ফেটে জ্বালা যন্ত্রণা করে। তাই এ সময়ে বাইরে বেরোলে অবশ্যই সানস্ক্রিন ক্রিম ত্বকে মেখে বের হতে হবে। ক্রিমের গায়ে সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর বা এসপিএফ লেখা নিশ্চিত হয়ে কিনতে হবে। আমাদের দেশের লোকের জন্য এসপিএফ ১৫ যথেষ্ট। মুখমন্ডলে এক চা চামচ এবং পুরো শরীরে দুই চা চামচ সানস্ক্রিন ক্রিম বা লোশন মাখতে হবে। এ সময়ে চোখে সানগ্লাস পরা ভাল। রিকশায় চড়লে সর্বদা হুড উঠিয়ে চলতে হবে। গাঢ় রং এবং কালো পোশাক এড়িয়ে হালকা রঙের কিংবা সাদা রঙের পোশাক পরা গরমের জন্য উত্তম।
গরমে শরীরে ঘাম জমে ছত্রাক সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। ঘাম শরীরের বিভিন্ন ভাঁজে বিশেষ করে কুঁচকিতে, আঙুলের ফাঁকে ও জননাঙ্গে জমা হয়ে সেখানে ছত্রাক সংক্রমণের পথ বিস্তার করে দেয়। তাই এ সময়ে ছত্রাক সংক্রমণ এড়াতে হলে শরীরের ভাঁজগুলোতে ঘাম জমতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ছত্রাকবিরোধী পাউডার এসব স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক দিন আন্ডারওয়্যার ও মোজা পরিষ্কার করতে হবে।
গরমে শরীরে ঘামাচি দেখা দিতে পারে। ঘামাচির চুলকানি রোধ করতে হলে অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ খাওয়ার পাশাপাশি ঘামাচি থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে হবে। ঘামাচি থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কখনো সিনথেটিক পোশাক পরা চলবে না। পরিষ্কার পানি দিয়ে গোসল করতে হবে। প্রয়োজনে একাধিকবার গোসল করা যেতে পারে। শরীরে ট্যালকম পাউডার বেশি না ঢালাই শ্রেয়। রাতে শোবার সময় শরীর থেকে ভারি পোশাক খুলে ফেললে ভালো।
ডা: এম ইয়াছিন আলী
জনস্বাস্থ্যবিষয়ক লেখক,
চেয়ারম্যান ও চীফ কনসালটেন্ট
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমন্ডি, ঢাকা ।
মোবাঃ ০১৭১৮৭-১০৬৭০২।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন