দেশের চলমান বন্যা আরও বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ১৬টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে এ বন্যা বেড়ে দেশের ২৩ থেকে ২৪টি জেলা প্লাবিত হতে পারে বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রে জানিয়েছে। আর এই বন্যার স্থায়িত্ব ১ মাসেরও বেশি সময় হতে পারে। অর্থাৎ আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ বন্যা থাকতে পারে। এতে আমন চাষ ব্যাহত হবে। চলতি বন্যায় এমনিতে কৃষকের অনেক আউশের ক্ষেত ডুবে গেছে এবং নষ্ট হয়েছে আমন ধানের বীজতলা। বন্যা আরও বিস্তৃত এবং দীর্ঘস্থায়ী হলে আমনের বীজতলা তৈরিতে সমস্যা হবে এবং ব্যাহত হবে আমন চাষাবাদ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলেছে, মধ্য আগস্ট পর্যন্ত আমনের আবাদ করা যাবে। ১৫ থেকে ২০ দিন বয়সী চারা রোপণ করতে হলে জুলাইয়ের মধ্যেই বীজতলা প্রস্তুত করতে হবে। ফলে চলতি মাসজুড়ে বন্যার এই অবস্থা বিরাজ করলে কৃষকদের বীজতলা প্রস্তুত করে চারা উৎপাদনই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। আর তা হলে চারার অভাবে আমন চাষাবাদে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, এবার দেশে ৫৯ লাখ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে এক কোটি ৫৬ লাখ টন। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) থেকে ইতোমধ্যে সাড়ে ১৯ হাজার টন ধানের বীজ চাষিপর্যায়ে বিক্রির জন্য ২০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে উৎপাদনের আশার মধ্যেই বন্যার প্রকোপ বেড়েছে। আর এতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বন্যা দীর্ঘতর হলে অনেক অঞ্চলে আমনের আবাদ ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অবশ্য বন্যা পরিস্থিতি সরকার পর্যবেক্ষণ করছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী। বিশেষ করে আমনসহ বিভিন্ন ফসলের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখার কথা জানান তিনি। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রতি বছরই বন্যার কারণে আউশ ও আমনের ফলন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বিশেষ করে বন্যার কারণে আমন ফসলটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। বিকল্প বীজতলা তৈরি, নিয়মিতভাবে আবহাওয়া মনিটরিং, ভারতের সঙ্গে যোগাযোগসহ সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে যাতে করে বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি মোকাবিলা করা যায়।
কৃষি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, করোনাভাইরাস ও চলমান বন্যার পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে আমন আবাদের সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। এ সময়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমন চাষে এবারই প্রথম কৃষককে বীজে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। আমন উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কম ফলনশীল জাতের আবাদ কমিয়ে আধুনিক অর্থাৎ উফশি জাতের সম্প্রসারণ ও হাইব্রিড জাতের এলাকা বৃদ্ধির কার্যক্রম চলছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে আমন বীজসহ বিভিন্ন প্রণোদনা কৃষকের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুল মুঈদ বলেছেন, বন্যা পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে তারা নতুন একটি পরিকল্পনা নিয়ে রেখেছেন। মেশিনের মাধ্যমে চারা রোপণের অংশ হিসেবে বীজতলার ট্রে পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন তারা। অবশ্য পরীক্ষামূলক হওয়ায় খুব বেশি সম্প্রসারিত হচ্ছে না এই উদ্যোগ। পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রয়োজনীয় উপজেলাগুলোর ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। তিনি বলেন, প্রতি বিঘা বীজতলার জন্য ২৫টি ট্রে দরকার হয়। প্রতি উপজেলার জন্য ১৫ থেকে ২০ বিঘা বীজতলা নির্মাণের মতো ট্রে সরবরাহ করার প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। বন্যার পানি সরতে দেরি হলে জমিতে বাঁশের মাচা বানিয়ে ট্রেতে বীজতলা নির্মাণ করার নির্দেশনা দেয়া হবে। তবে সে রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে না বলেই আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বন্যার জন্য আমন চাষ ব্যাহত হলে খাদ্য নিরাপত্তায় সরকারের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে বলে মনে করছেন খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম। চলমান বন্যা পরিস্থিতি ইতোমধ্যে আমনের জন্য বিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে আউশের খুব একটা ক্ষতি হচ্ছে না। তবে আমনের বীজতলার জন্য বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। আমন মার খেলে সরকারের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি হবে। এ জন্য কৃষকদের বেশি বেশি সচেতন করা উচিত। তারা যেন উঁচু জমিতে বীজতলা তৈরি করেন।
চলতি বন্যায় কৃষিতে ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে ৫ হাজার ৬৫৩ হেক্টর। এর মধ্যে আমন বীজতলা ৪৩৫ হেক্টর, আউশ ৮২৫ হেক্টর, তিল ২৪০ হেক্টর, কাউন ৫ হেক্টর, চিনাবাদাম ৮০ হেক্টর, মরিচ ৫৮ হেক্টর এবং পাট অর্ধ নিমজ্জিত হয়েছে ৩৫৯০ হেক্টর। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান প্রধান বলেন, বন্যায় ১ হাজার ৬৯২ হেক্টর জমির ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। টানা বৃষ্টি আর বন্যার কারণে কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে। বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আমন বীজতলা তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন