যে সকল কাজ সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম ও সাধারণ জনগণ কর্তৃক সংঘটিত হওয়া অসম্ভব তা আল্লাহপাক কোনো নবীর মাধ্যমে প্রকাশ করলে তাকে মুজিযাহ বলে।
আরবি মু’জিযাহ শব্দটি ইজযুন শব্দ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ হলো অক্ষম করা, অপারগ করা। এটি আরবি কুদরত শব্দের বিপরীত শব্দ। মূলত : মু’জিযা হলো ইজযুন-এর কর্তা। যিনি অন্যের মধ্যে অক্ষমতা সৃষ্টি করেন। আর তিনিই হলেন সর্ব শক্তিমান আল্লাহ। (মিরকাত শরহে মিশকাত : খন্ড-২, পৃষ্ঠা ৫৩০)। মূলত : মু’জিযাহ হলো সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এবং কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে আহ্বানকারী এবং যা নবুওয়াতের দাবির সাথে সম্পৃক্ত। যার দ্বারা ঐ ব্যক্তির সত্যতা প্রকাশ করা উদ্দেশ্য যিনি আল্লাহতায়ালার রাসূল হওয়ার দাবি করেন। (যুরজানী: কিতাবুত তারিকাত : পৃষ্ঠা ১৭৬)। বিষয়টিকে এভাবেও বলা যায় যে, সাধারণ নিয়মকে ভঙ্গ করে নবুওয়াতের দাবিদারের হাতে নবুওয়াতের অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারীদের সামনে সে কাজ সংঘটিত হয় এবং অন্য কোনো ব্যক্তি তা করতে সক্ষম হয় না তাই মুজিযাহ। (মজমুয়ায়ে ফাতাওয়া : খন্ড ২, পৃষ্ঠা ১৮)।
কোনো নবীর সত্যতা প্রমাণের জন্য তাঁর হাতে আল্লাহপাকের নির্দেশে কোনো মুজিযাহ প্রকাশ পাওয়া আসমানী দলীল ও প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়। জেনে রাখা ভালো যে, আম্বিয়া কেরামের নবুওয়াতের অকাট্য প্রমাণ হলো তাদের মুজিযাহসমূহ। মুজিযাহ এমন কর্ম বা আল্লাহ তায়ালা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম পদ্ধতিতে নবুওয়াতের দাবিদারের হাতে প্রকাশ করে থাকেন। এর দ্বারা তাঁর নবুওয়াতের দাবির সত্যতার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ জাতীয় কাজের বহিঃপ্রকাশ যেন তাঁর প্রতি আল্লাহর এ উক্তির স্থলাভিষিক্ত” তুমি আমার রাসূল। তোমার দ্বারা মুজিযাহ প্রদর্শন মূলত : তোমার দাবিরই সত্যায়ন মাত্র”। (আল ইউওয়াকিতু ওয়াল জাওয়াহিরু : খন্ড ১, পৃষ্ঠা ১৫৮)।
বস্তুত : কোনো নবীর নবুওয়াতের মৌলিক প্রমাণ হলো তাঁর সত্তা, তাঁর গুণাবলী এবং জনগণের সামনে তাঁর উপস্থাপিত শিক্ষা। এগুলো দেখেই সুস্থ মস্তিষ্ক, জ্ঞানসম্পন্ন মেধা শক্তির অধিকারী ব্যক্তি ঈমান আনয়ন করে। আপামর জনসাধারণের মধ্যে যারা বাহ্যিক ও অনুভব যোগ্য নিদর্শনে প্রভাবিত হয়ে থাকে, আল্লাহতায়ালা তাদের জন্য মুজিযাহ প্রকাশের ব্যবস্থা করে থাকেন। আর যাদের জন্য বঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নির্ধারিত নেই, তারা মুজিযাহ দেখেও ঈমান আনায়ন করার সৌভাগ্য লাভ করতে পারে না।
মোটকথা, মুজিযাহ তালাশকারীদের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যায় যে, তারাই মুজিযাহ তালাশ করে যাদের ঈমানী শক্তি দুর্বল। অন্যরা মুজিযার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। বরং তারা রাসূল সে বাণী নিয়ে এসেছেন তার প্রতি প্রথম আহ্বানেই ঈমান আনায়ন করে। কেননা, তাদের ঈমানের অংশটি সবল। কাজেই অতি সহজেই তারা নবীর আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। পক্ষান্তরে যার মধ্যে ঈমানের কোনো যোগ্যতা নেই, সে মুজিযাহ প্রত্যক্ষ করেও ঈমান আনয়ন করতে পারে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন : ‘আল্লাহ যাকে পথ হারা করতে চান, তিনি তার বক্ষকে সংকুচিত করে দেন। তার কাছে ব্যাপারটি এমন কষ্ট সাধ্য হয় যেন সে ঊর্ধ্ব আকাশ পানে আরোহণ করছে’। (সূরা আল আনয়াম : আয়াত ১২৫। আল ইউওয়াকিতু ওয়াল জাওয়াহিরু : খন্ড ১, পৃষ্ঠা ২১৫)।
মহান আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা জনগণ যেন ভ্রান্তিতে পতিত না হয় সে লক্ষ্যে কোনো মিথ্যা ও ভন্ডনবী দাবিদারকে মুজিযাহ দান করেননি। এমন কি তার কোনো ভবিষ্যৎ বাণীও পূর্ণ হতে দেননি। যেমনটি মুসায়লামাতুল কাজজাব ও মির্যাকাদিয়ানী সহ অন্যান্য মিথ্যা নবী দাবিদারদের বেলায় দেখা যায় যে, তাদের কোনো ভবিষ্যদ্বানী সত্যে পরিণত হয়নি। বরং বাস্তবতা সর্বদাই তাদের বিপরীত ছিল। তাই সকল মুহাক্কিক উলামাগণ এ ব্যাপারে একমত যে, মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার ব্যক্তির হাতে মুজিযাহ প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, মুজিযাহর উদ্দেশ্য হলো নবুওয়াতের দাবিকে অকাট্যভাবে সত্য বলে প্রমাণ করা। সুতরাং ভন্ড নবীর দ্বারা মুজিযাহ প্রকাশ পেলে পৃথিবীতে রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। এমনটি কখনও হওয়া সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মধ্যে পার্থক্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মিথ্যা নবী দাবিদারদের দ্বারা কোনো মুজিযাহ প্রকাশ পায়নি। (নিবরাস : পৃষ্ঠা ২৭২-২৭৩)।
নবীগণের যে সকল মুজিযাহ অকাট্য প্রমাণাদি দ্বারা প্রমাণীত তার ওপর ঈমান আনয়ন করা ফরজ। এরূপ মুজিযার কোনো একটি অস্বীকার করলে মানুষ ইসলামের গন্ডি হতে বের হয়ে যাবে। যেমন : হযরত নূহ (আ.) এর কিশতীর মুজিযাহ, হযরত সালেহ (আ.)-এর উটের মুজিযাহ, হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর অগ্নিকুন্ড ফুল বাগিচায় পরিণত হওয়া, বিশ^নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা.)-এর জন্য কোরআন মাজীদ, মি’রাজের ঘটনা ইত্যাদি মুজিযাহসমূহের ওপর ঈমান আনয়ন বাধ্যতামূলক। এর অন্যথা হবার যো নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন