মহান আল্লাহ মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাতরূপে সৃষ্টি করেছেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা। বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে পানাহার করতে হয়। খাদ্য ও পানীয় ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির উদ্দেশে বলেছেন, তোমরা খাও এবং পান করো কিন্তু অপচয় কোরো না। অবশ্যই আল্লাহ অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ (০৭) : ৩১)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসিরকার আল্লামা ইবনে কাসীর একখানা হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। হাদিসখানা এই, হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. থেকে বর্ণিত, হযরত নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমার মনে যা চায় তা-ই খাওয়া অপচয় ও সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। (তাফসিরে ইবনে কাসীর : ২/৭২৭)।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদিস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পানাহারের ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ ও সংযমের নির্দেশ দিয়েছেন। মনের লোভ ও চোখের ক্ষুধাবশত অতিরিক্ত ভ‚রিভোজন, খাদ্যগ্রহণ সীমালঙ্ঘন কিংবা ভোজনরসিক হওয়ার ব্যাপারটি ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। পানাহারে সীমালঙ্ঘনকারীকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। পবিত্র কোরআনের এ কথাটি থেকেও বোঝা যায়, বেশি খেলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য।
বর্তমান যুগে উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও দক্ষ চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতেও অতিভোজন মানুষের জন্য বিশেষ ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগসহ নানা ধরনের মারাত্মক রোগের জন্যও অপরিমিত খাবারকে দায়ী করা হয়। উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মোটা বা মেদবহুল হওয়া আজ এক অভিশাপরূপে দেখা দিয়েছে। অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ, মুখরোচক খাবার নিয়ন্ত্রণহীনভাবে খেয়ে চলা, অন্যমনস্ক অবস্থায় অধিক খাবার গ্রহণ, অধিক পরিমাণে ফাস্টফুড নেয়া ইত্যাদি কারণে পাশ্চাত্যের একটি প্রজন্ম নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে।
বিশ্বব্যাপী প্রধানত অধিক খাবার গ্রহণ, সঞ্চিত ক্যালোরি খরচ করার ব্যবস্থা না রেখেই আরো ক্যালোরি সঞ্চয় প্রভৃতি কারণেই কোটি কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস একটি দুরারোগ্য ব্যাধি হলেও শৃঙ্খলা মেনে এ রোগ নিয়েও জীবন চালানো যায়। তবে এ রোগ থাকার দরুন মানুষ অসতর্কতার ফলে আরো জটিল কিছু রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে পূর্বসর্তকতা ও পানাহারে শৃঙ্খলা পালন করলে ডায়াবেটিস থেকে আত্মরক্ষা সম্ভব। বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি মানুষের জীবনে ডায়াবেটিস যে জটিলতা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এর নির্মম শিকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পূর্বসতর্কতা ও সচেতনতা অনেকাংশেই ডায়াবেটিস থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারে। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় ৯৩ ভাগ মানুষ ইসলামে বিশ্বাসী। অপরাপর সব নাগরিকও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি আস্থাশীল। অতএব পবিত্র ইসলাম তথা কোরআন ও হাদিসের আলোকে পানাহারে সংযম, নিয়ম-শৃঙ্খলা ও পরিমিতিবোধ বিষয়ক কিছু দিকনির্দেশ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে স্বাস্থ্য-সচেতন এবং ডায়াবেটিস প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।
চিকিৎসা-সংক্রান্ত একটি মূলনীতি চালু রয়েছে যে, Prevention is better than cure অর্থাৎ চিকিৎসার চেয়ে পূর্বসতর্কতাই উত্তম। সুতরাং প্রতিরোধ ও সচেতনতা আমাদের রোগ হওয়ার আগেই সুরক্ষা দিতে পারে। বর্ণিত আছে, পরিপাকতন্ত্র সব রোগের কেন্দ্র আর পূর্বসতর্কতা সব চিকিৎসার মূল। ইতিহাসে পাওয়া যায়, একবার হযরত ওমর রাযি. এর শাসনামলে সিরিয়া থেকে একটি চিকিৎসক দল মদিনা শরীফে শুভেচ্ছা সফরে আসে। খ্রিষ্ট ধর্মাবলম্বী এ চিকিৎসকরা মুসলিম সমাজের নাগরিকদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা দিতে মনস্থ করলেন। কিন্তু ঘোষণা সত্তে¡ও আশানুরূপ রোগী চিকিৎসা নিতে এলো না। ক’দিন পর চিকিৎসক দলের সদস্যরা বিস্মিত হয়ে মদিনার এক রাখালকে প্রশ্ন করলেন, বিনা পয়সায় উন্নত চিকিৎসাসেবা পেয়েও তোমরা কেন আমাদের শিবিরে আসছ না?
এখানে রাখাল তরুণটি যে উত্তর দিয়েছিল তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সে বলেছিল, আমরা মদিনাবাসী সাধারণত কোনো রোগ-ব্যাধির শিকার হই না। কারণ, আমরা আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার ওপর আমল করি। তাঁর কথামতো আমরা তৃপ্ত হয়ে খাওয়ার সময়ও পেটকে তিন ভাগে ভাগ করি। এক ভাগ খাদ্য, এক ভাগ পানীয় আর এক ভাগ আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য খালি। তা ছাড়া ক্ষুধা লাগলেই শুধু আমরা খাবার গ্রহণ করি আর কিছু ক্ষুধা থাকা অবস্থায় খাওয়া শেষ করি।
পরবর্তীকালে খলিফা হারুনুর রশীদের শাসনামলেও একটি ঘটনা ইতিহাসে পাওয়া যায়। সেখানে একজন বিশেষজ্ঞ খলিফার কৌত‚হলের জবাবে বলেছিলেন, সুস্থতার জন্য বড় পরামর্শ হচ্ছে ইসলামের খাদ্য গ্রহণ রীতি। সেখানে বলা হয়েছে, পূর্ণ ক্ষুধা না পেলে খাবার খেয়ো না। আর কিছু ক্ষুধা থেকে যাওয়া অবস্থায়ই খাওয়া শেষ করো। খলিফা হারুনুর রশীদ তখন এ পরামর্শটি গ্রহণের জন্য সবাইকে উৎসাহিত করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন