মূল লেখার আগে একটি আমলের কথা বলে দিচ্ছি। হজের অংশ না হলেও আমলটি গুরুত্বপূর্ণ। হজ দোয়া কবুলের বিশাল উপলক্ষ ও আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং পাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ। করোনা মহামারির কারণে যদিও এবার খুব বেশি মানুষ হজ আদায় করতে পারছে না। হজের মর্তবা তাই বলে এতটুকুও কমবে না। হযরত ইবরাহীম আ: এর পবিত্র স্মৃতি বিজড়িত এ হজে রয়েছে কোরবানির মহান স্মৃতি। ত্যাগের এত বড় নিদর্শন দুনিয়ায় আর পাওয়া যায় না।
প্রায় ৫০০০ বছর আগে মহান আল্লাহর নির্দেশে নিজ সন্তানকে কোরবানি করেন তিনি। হজের সময় মিনায় এবং সারাবিশ্বে মুসলিম জাতি এ সুন্নতে ইবরাহীমি পালন করে থাকে। সক্ষম মুসলিমদের জন্য কোরবানি করা ওয়াজিব। অলৌকিকভাবে ইবরাহীম (আ:)-এর সন্তানের বদলে আল্লাহ কোরবানি কবুল করে নেন জান্নাত থেকে প্রেরিত একটি দুম্বা দিয়ে। এরপর বলা হয়, ইবরাহীম (আ:) আপনার কোরবানি আমি কবুল করলাম। এ কবুলের মুহ‚র্তে আল্লাহ তাকে আরেকটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। যার নাম হযরত ইসহাক (আ:)। এ জন্য সন্তানের জন্য পিতার দোয়া কবুলের এ এক বিশেষতর মওসুম।
অভিজ্ঞতা থেকে অনেকে বলেন, হজের দিনগুলোতে অর্থাৎ জিলহজের ৭, ৮, ৯ ও ১০ তারিখ পিতা-মাতা নিজ সন্তানদের জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে। এ দিনগুলোতেই হযরত ইবরাহীম (আ:) তার সন্তানের জন্য খাস দোয়া ও ত্যাগের পরীক্ষা দান করেছিলেন। সন্তানের জীবন, সম্পদ, মানমর্যাদা ও দ্বীন-ঈমানের নিরাপত্তার জন্য সব পিতা-মাতা দোয়া করুন। তাদের উত্তম বিয়েশাদি, সুখী জীবন ও নেক বংশধরের জন্য দোয়া করুন। বিশেষ করে হজের দিন (৯ জিলহজ) আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত দোয়া বেশি কবুল হয়। দোয়ার আগে ও পরে ২১ বার দরুদে ইবরাহীম (যা নামাজে পড়া হয়) পড়া এবং সম্ভব হলে ৪৪৭ বার ‘আল্লাহহুম্মা লাব্বাইক’ পড়া ভালো।
হাজী সাহেবান মিনায় তিনদিন অবস্থান করেন এবং সেই স্তম্ভগুলোতে পাথর নিক্ষেপ করেন যাহা জামারায়ে উলা, জামারায়ে উসতা এবং জামারায়ে ওকবা নামে পরিচিত। এটা হযরত ইব্রাহীম আ. এর আমলের স্মৃতি চিহ্ন। (ক) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত আছে, হুযুরে আকরাম সা. বলেছেন, জিব্রাঈল আমীন ইব্রাহীম আ. কে নিয়ে জামারায়ে ওকবাতে উপস্থিত হলেন। সেখানে তাদের সামনে শয়তান হাজির হলো। তিনি একে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন। ফলে সে জমিনে ডেবে গেল। তারপর তিনি জামরায়ে উসতায় তশরীফ আনয়ন করেন। তখন শয়তান দ্বিতীয়বার সামনে এসে হাজির হলো। তিনি তার প্রতি সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন। ফলে সে পুনরায় জমিনে ডেবে গেল। তারপর তিনি জামারায়ে উলায় পৌঁছলেন। এখানেও শয়তান সামনে এসে হাজির হলো। তিনি তার প্রতি সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন। ফলে সে পুনরায় জমিনে ডেবে গেল। [আহমদ বিন হাম্বল: আল মুসনাদ, খন্ড ১, পৃ. ৩৯৬; হাকেম: আল মুস্তাদরাক আলাস সাহীহাইনি, খন্ড ১, পৃ. ৬৩৮; বর্ণনা সংখ্যা ১৭১৩]
(খ) অন্য একটি বর্ণনায় স্বয়ং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, নিশ্চয়ই হযরত ইব্রাহীম আ. কে যখন হজের হুকুম পালন করার নির্দেশ দেয়া হলো, তখন হযরত জিব্রাঈল আ. তাকে জামারায়ে আকাবার কাছে নিয়ে গেলেন, সেখানে তার সামনে শয়তান এসে হাজির হলো। তিনি তাকে সাতটি কঙ্কর নিক্ষেপ করলেন, এতে সে চলে গেল। পুনরায় সে তার সামনে জামারায়ে উসতায় এসে হাজির হলো। তিনি তাকে সাতটি কঙ্কর মারলেন। তা ওই স্থান ছিল, যার সম্পর্কে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কোরআনের আয়াত তিলাওয়াতের মাধ্যমে বললেন, হযরত ইব্রাহীম আ. হযরত ইসমাঈল আ. কে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন।
তখন হযরত ইসমাঈলের গায়ে সাদা রং এর জামা ছিল। তিনি বললেন, আব্বাজান, আমার নিকট এই জামাটি ছাড়া অন্য কোনো কাপড় নাই, যা দ্বারা আপনি আমার কাফন দিতে পারেন। সুতরাং এই জামাটি আমার শরীর হতে খুলে নিন, যাতে এর দ্বারা আপনি আমার কাফন দিতে পারেন। সুতরাং তিনি তাকে সোজা করলেন এবং সেই জামাটি খুলে নিলেন। এমন সময় পিছন দিক হতে গায়েবি আওয়াজ আসল, হে ইব্রাহীম, অবশ্যই তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। হযরত ইব্রাহীম আ. পিছন ফিরে দেখলেন, সেখানে বড় বড় চোখ ও সিং বিশিষ্ট সাদা রংয়ের একটি পাঠা দাঁড়িয়ে আছে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এখানে নিজের মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, আমার ধারণা আমরা এই ধরনের পাঠা ক্রয় বিক্রয় করি। তারপর তিনি বলেছেন, জিব্রাঈল আ. হযরত ইব্রাহীম আ. কে জামারায়ে উলাতে নিয়ে গেলেন। সেখানেও শয়তানের সঙ্গে সংঘর্ষ হলো। তিনি তাকে সাতটি কঙ্কর মারলেন। ফলে সে পালিয়ে গেল। [স‚রা সাফফাত: আয়াত ১০৩; তাবরানী: আল মুজামুল কবীর, খন্ড ১০, পৃ. ২৬৮, বর্ণনা সংখ্যা ১০৬২৮; ইবনে কাছির: তাফসিরুল কোরআনিল আজীম, খন্ড ৪, পৃ. ১৬]
হযরত ইব্রাহীম আ. শয়তানকে কঙ্কর মারার সাথে সাথে তাকবীর (আল্লাহ আকবার) বলেছিলেন। নিম্নের বর্ণনাবলী দ্বারা এর প্রমাণ পাওয়া যায়। (গ) হযরত মুজাহিদ বিন যুবায়ের (মৃ. ১০৪ হি.) বলেন: জিব্রাঈল আমীন হযরত ইব্রাহীম আ. কে নিয়ে জামারায়ে আকাবা অতিক্রম করছিলেন, সেখানে ইবলিস দাঁড়িয়ে ছিল। হযরত জিব্রাঈল হযরত ইব্রাহীম আ. কে বললেন, তাকবীর বলে তাকে কঙ্কর মার। তারপর জামারায়ে উসতায় ইবলিস সামনে আসলে হযরত জিব্রাঈল হযরত ইব্রাহীম আ. কে বললেন তাকবীর বলে তাকে কঙ্কর মার।
তারপর জামারায়ে উলাতে ইবলিস দেখা দিলে হযরত জিব্রাঈল আ. হযরত ইব্রাহীম আ. কে বললেন, তাকবীর বলে তাকে কঙ্কর নিক্ষেপ কর। [আজরাকী: আখবারে মক্কা ওয়ামা জ্বাআ ফীহা মিনাল আছার, খন্ড ১, পৃ. ৬৮] শয়তানকে কঙ্কর মারা শুধু কেবল হযরত ইব্রাহীম আ. এরই সুন্নত নয়, বরং তা হযরত আদম আ. এরও সুন্নত। যেমন নিম্নের বর্ণনায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ইমাম কালবী বলেন: জিমারকে এই জন্য জিমার (কঙ্কর নিক্ষেপের স্থান) বলা হয় যে, হযরত আদম আ. শয়তানকে কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন এবং সে দ্রুত তার সম্মুখ হতে পলায়ন করত।
আল্লাহপাকের মাহবুব বান্দা সাইয়্যেদেনা ইব্রাহীম আ. আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বে যে কাজ করেছিলেন, আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের বারগাহে তা মকবুল হলো। উম্মতে মুসলিমার এর ওপর আমল করার সৌভাগ্য নসীব হলো। এই আমল হাজীদের জন্য লাজেম সাব্যস্ত করা হয়। এবং যতক্ষণ পর্যন্ত এই আমল বারবার করা না হয়, হজের মতো বিশাল ইবাদতও পূর্ণতা লাভ করে না। এই আমল পয়গাম এবং উদ্দেশ্য হতে খালি নয়। এ থেকে তিনটি বিষয়ের শিক্ষা লাভ করা যায়। প্রথমত: এভাবে আম্বিয়াগণের সুন্নত জারী থাকে। দ্বিতীয়ত: এই আমলকে বারবার আদায়ের মাধ্যমে সেই মর্যাদাবান পয়গাম্বরদের প্রতি মহব্বতের প্রেরণা এবং আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রকাশ পায়। তৃতীয়ত: মুসলমানগণ সেই চিহ্নিত প্রতীকী শয়তানগুলোকে কঙ্কর নিক্ষেপ করে তাদের প্রতি নিজেদের ঘৃণা প্রকাশ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন