হজ আল্লাহ তায়ালার খুব বড় একটি হুকুম। ইসলামের মূল পাঁচ স্তম্ভের একটি। যার পক্ষে সম্ভব জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এরপর নফল হজ আরো করা যায়।
ওমরা করা যায়। রমজানে ওমরা করা নবী করিম সা. এর সাথে হজ করার সমান। কিন্তু এ হজ ও ওমরা সচেতনভাবে বুঝে শুনে ক’জন করতে পারে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, মানুষের ওপর আল্লাহর হক এই যে, তাদের মধ্যে যাদের পক্ষে সম্ভব তারা যেন আমার ঘরে আসে। প্রিয় নবী সা. বলেছেন, কবুল হজ মানুষকে এমন করে দেয়, যেমন সে মায়ের পেট থেকে নিষ্পাপ হয়ে জন্মেছিল। তিনি আরো বলেন, এক ওমরা থেকে আরেক ওমরা এর মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ। অপর হাদিসে তিনি এও বলেছেন, সক্ষম হওয়া সত্তে¡ও যে ব্যক্তি হজ করল না, সে ইহুদি হয়ে মরুক বা নাসারা হয়ে মরুক (এ নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই)। -আল হাদিস।
নিষ্পাপ নবজাতকের মতো হওয়ার জন্য ইসলাম বহু পথ খোলা রেখেছে। সবসময় তাওবা ইস্তেগফার করা, এক জুমা থেকে আরেক জুমা মধ্যবর্তী গুনাহের কাফফারা স্বরূপ, রমজানের রোজা ও তারাবি, দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ইত্যাদিও গুনাহ মুক্তির পথ। একজন রোগী দেখতে গেলে দু’টি হজ, দু’টি ওমরা ও একজন কৃতদাস মুক্ত করার সওয়াব পাওয়া যায়। এটি হাদিস শরিফের কথা। সুবহানাল্লাহ।
ফরজ হজের পর নফল হজ ও ওমরা যদিও সওয়াবের কাজ, কিন্তু এসবের তুলনায় আরো বেশি সওয়াবের কাজ আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু নিয়ত যদি সহিহ না হয়, লোক দেখানো উদ্দেশ্য থাকে, যাকে শরিয়তে বলা হয় ‘রিয়া’। এটি মহাপাপ। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে- রিয়া হচ্ছে গোপন শিরক। নাউযুবিল্লাহ। আমাদের দেশে প্রচারের জন্য কিছু লোক নফল হজ-ওমরা করে। নির্বাচনের জন্য করে।
গল্প আছে, এক নেতা আলেমদের দাওয়াত করে বাসায় নিয়েছেন, নামাজের সময় হলে ঘরেই জামাত পড়ার ইচ্ছা করলেন আলেমরা। বললেন, একটি জায়নামাজ ও দু’টি পবিত্র বেডশিট হলেই চলবে। তখন নেতা বললেন, বেডশিট কেন? আমার বাসায় জায়নামাজই আছে। কাজের লোকেরা জায়নামাজ আনলে তিনি বলতে থাকেন, এটা তো তিন বছর আগের, গতবার যেগুলো আনলাম সেগুলো কই। এর আগের বারেরগুলো কই। আল্লাহর রহমতে এ পর্যন্ত ১১ বার হজ-ওমরা করেছি। আলেমগণের মতে, এটিও এক ধরনের প্রচার ও রিয়া।
এখানে বলা হচ্ছে, হালাল উপার্জনের নফল হজ ওমরার কথা। হারাম টাকার কথা তো আলাদা। এর দ্বারা হজ-ওমরা করে সওয়াবের আশা করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা কিতাবেই লেখা আছে। যেমন, সুদ ও হারাম টাকা দান করে সওয়াবের আশা করা ঈমান নষ্টের কারণ হয়ে থাকে। এদেশে এক ধরনের অজ্ঞ অথচ আবেগি লোক আছে, যারা টাকা হাতে এলেই নফল হজ ও ওমরায় ছুটে যায়।
তারা ভাবে না যে, সওয়াবের আশায় সেখানে গিয়ে তারা ফরজ হজ ওমরাকারীদের কোটা নষ্ট করছে। টিকিট, থাকা, খাওয়া, ট্রান্সপোর্ট, হজ সম্পাদন ইত্যাদি সর্বত্র চাপ সৃষ্টি করছে। বাড়তি ভিড় তৈরিতে ভ‚মিকা রাখছে। সহনীয় পর্যায়ে এমন নফল হজ ও ওমরার অনুমোদন শরিয়তে রয়েছে বটে, তবে এমন বিত্তশালী মানুষের আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব এবং অধিক সওয়াব অর্জনের ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন।
দরিদ্র আত্মীয়দের সাহায্য করা, মরণব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের সাহায্য, গরিবদের বিয়েতে সাহায্য, অসহায় পরিবারের কাউকে বিদেশ প্রেরণ, অসচ্ছল ব্যক্তিকে উপার্জনের পথ বের করে দেয়াসহ বহু ফরজ-ওয়াজিব দানের দুয়ার খোলা আছে। যেসব না করলে প্রকৃত মুমিন হওয়াও সম্ভব নয়। এসব বাদ দিয়ে শুধু ঘনঘন নফল হজ-ওমরা অনেকের মাথায় ঢুকে গেছে। এসবই সমন্বিত ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। ইতিহাসে এ বিষয়ে একটি ঘটনা স্মরণযোগ্য।
একবার বাগদাদের এক দরিদ্র ব্যবসায়ী বহু কষ্টে হজে যাওয়ার অর্থ জোগাড় করল। সে ছিল একজন বড় শাইখের ভক্ত ও মুরিদ। শাইখের সাথে যারা সে বছর হজে যাবে, তাদের মাঝে তার নামও ছিল। রওয়ানার দিন লোকটি কাফেলার সাথে যেতে পারে নি। তাকে রেখেই শাইখের কাফেলা হজে চলে যায়। লোকটির না যাওয়ার কারণটি ছিল বড়ই অদ্ভুত।
হজের রওয়ানার পূর্ব মুহূর্তে সে যখন খানা খেতে বসল তখন শুকনো রুটি ও আচার ছাড়া তার ঘরে কিছু ছিল না। পাশের বাড়ি থেকে তখন গোশত রান্নার ঘ্রাণ আসছিল। লোকটি তার স্ত্রীকে বলে পাঠাল, আমার স্বামী হজে রওয়ানা হচ্ছেন। ঘরে খাবার তেমন কিছু নেই। তোমরা যদি আমাদের সামান্য তরকারি দিতে। তখন প্রতিবেশী গৃহিণী কেঁদে ফেলল। বলল, এ তরকারি ভাইকে দেয়া যাবে না।
লোকটির স্ত্রী জানতে চাইল, কেন? গৃহিণী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, সেটাও বলা যাবে না। তখন অনেক পীড়াপীড়ি করে যা জানা গেল, তা ছিল খুবই দুঃখজনক। গৃহিণী বলল, আমি ও আমার এতিম বাচ্চারা গত তিন দিন ধরে উপোস করছি। আজ অপারগ হয়ে ছেলেরা ভাগাড় থেকে মৃত পশুর কিছু গোশত এনে জীবন রক্ষার্থে একটু তরকারি পাকাচ্ছে।
এটি কোনোরকম ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আমাদের বেলায় জায়েজ হতে পারে। কিন্তু তোমাদের জন্য বিশেষ করে ভাইয়ের জন্য এ তরকারি হালাল নয়। শত ইচ্ছা থাকলেও আমরা তাকে তা দিতে পারি না। ব্যবসায়ীর স্ত্রী খালি হাতে ঘরে ফিরে এলে স্বামী তার কাছ থেকে প্রতিবেশীর পূর্ণ অবস্থা জেনে যায়। নিজে আলেম বা মুফতি না হওয়া সত্তে¡ও সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, এবার সে হজে যাবে না।
প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে হজের টাকা থেকে তাদের চলার মতো অর্থ দান করে দেয়। ছেলেদের নিজের ব্যবসায় লাগিয়ে দেয়। ছোটদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে। দীর্ঘ দিনের আশা ও কষ্ট করে জমানো অর্থ অন্য কাজে ব্যবহৃত হয়ে যাওয়ায় এবং হজ করতে না পারায় তার মনে দুঃখ ছিল বটে, তবে সে মনে মনে বিশাল স্বস্তিও অনুভব করছিল। এভাবেই হজ শেষ হলো।
তার শাইখ ফিরে এলেন। তিনি মদিনা শরিফে থাকতেই স্বপ্নে দেখেছিলেন, কেউ যেন তার এই ব্যবসায়ী ব্যক্তিটিকে দেখিয়ে তাকে বলছে, এবার এই ব্যক্তিটির কারণেই সকল হজযাত্রীর হজ কবুল হয়েছে। শাইখ খুব খুশি হয়ে অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের এই ব্যবসায়ী বন্ধুটিকে কি কেউ কোথাও দেখেছ? আমাদের কাফেলায় তো আসেনি।
বাগদাদে ফিরে শাইখ লোকটির খোঁজ নিলেন। তার সাথে দেখা করে তাকে এই মোবারক স্বপ্নের কথা বললেন এবং তাকে অভিনন্দন জানালেন। শাইখের কথা শুনে লোকটি কাঁদতে লাগল। বলল, হুজুর আমি তো এবার হজেই যাইনি। শাইখের কাছে সে না যাওয়ার কারণটিও খুলে বলল। শাইখও তখন কাঁদতে লাগলেন। বললেন, সত্যিই তুমি হজের চেয়েও বড় দায়িত্ব পালন করেছ।
হাদিসে আছে- সে মুমিন নয়, যার প্রতিবেশী অভুক্ত থাকে আর সে নিজে পেট পুরে খায়। এতিম বিধবা প্রতিবেশীকে এ অবস্থায় রেখে তুমি হজে গেলে আল্লাহ তা পছন্দ করতেন না। হয়তো তোমার হজও কবুল হতো না।
কিন্তু ঈমানের দাবি পূরণ করায়, মানবতার অমোঘ আহ্বানে সাড়া দেয়ায় হজ না করেও তুমি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হজ পালনের মর্তবা লাভ করেছ। আধ্যাত্মিক জগতে তোমাকে হাজী হিসাবেই আল্লাহ স্থান দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তোমার নিয়ত নিষ্ঠা ত্যাগ ও মানবতার পরাকাষ্ঠায় তোমার উসিলায় এবারকার সব হাজীর হজই কবুল করে নিয়েছেন। লোকটি ছিল একজন সাধারণ চর্মকার। চামড়াজাত দ্রব্য প্রস্তুত ও বিক্রয়কারী। শাইখ তখন তাকে বললেন, আল্লাহ তোমাকে দ্রুতই সশরীরে হজে যাওয়ার তাওফিক দেবেন।
আমার কাছেও তোমার মর্যাদা এখন থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের স্পষ্ট বার্তা গ্রহণ করতে হবে। আমরা কি ঐচ্ছিক হজ ও ওমরায় বেশি বাড়াবাড়ি করছি কি না। বিশেষত এই করোনাকালে অনেকেই হজে যেতেন, কিন্তু যেতে পারছেন না বিধি নিষেধ থাকার কারণে। তারাও যদি করোনায় বিপর্যস্ত জনপদে দানের হাত প্রসারিত করেন, আল্লাহ তায়ালা তার বিনিময়ে অনেক কিছুই দিতে পারেন, যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না।
আমাদের চারপাশ, দেশ-সমাজ, পরিজন, প্রতিবেশী কেমন আছে, কী খাচ্ছে, কীসব সমস্যায় ভুগছে, কতরকম চাহিদা ও অভাবে ধুকছে। এসব আমাদের জানা ফরজ, ওয়াজিব থেকে কম নয়। এসব না জানলে, এসবের দাবি পূরণ না করলে আমরা ঈমানদারই হতে পারব না। হজ ওমরা কবুল হওয়া তো দূরের কথা। আল্লাহ সকলকে দ্বীনের সঠিক বুঝ দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন