ঘটনা চাঞ্চল্যকর। মামলা দায়ের হয় দন্ডবিধির কঠিন ধারায়। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চৌকস অফিসারদের ঘুম হারাম। আসামি খুঁজছেন তারা হন্যে হয়ে। এদিকে পাবলিক সেন্টিমেন্ট চরমে। আসামি কেন ধরা পড়ছে না! গুঞ্জন আর গুজব ডালপালা গজায়। টানটান উত্তেজনা। কর্তাব্যক্তিদের আশাব্যঞ্জক মন্তব্য-অন্যায় করে কেউ পার পাবে না! অপরাধী যেই হোক- ধরা তাকে পড়তেই হবে! নানা নাটকীয়তা। মাঝরাতে র্যাব-ডিবির রুদ্ধশ্বাস অভিযান। এর মধ্যে টিভিতে হঠাৎ করেই স্ক্রল-ব্রেকিং নিউজ। আসামি ধরা পড়েছে!! সীমান্তবর্তী জেলার অমুক খালপাড়। তমুক নদীর ঝাউবনের ঝোঁপে। কখনো বা কোনো সীমান্তবর্তী বিভাগীয় শহরে ‘উদভ্রান্তের মতো’ ঘুরে বেড়ানোর সময় গ্রেফতার হোন আসামি। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে ‘ধৃত’ সেই আসামিকে হাজির করা হয়। তোলা হয় আদালতে। রিমান্ড চাওয়া হয়। রিমান্ডে নিয়ে চলে জিজ্ঞাসাবাদ।
এরপরই ক্রমে পাল্টে যেতে থাকে মূল ঘটনা। ‘নির্ভরযোগ্য সূত্র’, কখনো বা ‘বিশ্বস্ত সূত্র’র বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হতে থাকে ধৃত আসামির যতসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। সাত খুনের মামলার প্রধান আসামির প্রকাশ হতে থাকে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের ফিরিস্তি। কোথায় কিভাবে কার জমি দখল করেছেন- কার কাছ থেকে কিভাবে চাঁদাবাজি করেছেন- প্রচার হয় সেই তথ্য।
তথ্য-প্রযুক্তি আইনে করা মামলায় প্রকাশ পেতে থাকে অভিযুক্তের নারী কেলেঙ্কারির রগরগে খবর। আবার নারী নির্যাতন মামলায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে প্রচার পায় তার ভ‚মি দস্যুতার খবর। ভ‚মি দস্যুর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার তদন্তে প্রচার পায় তিনি কয়টি বিয়ে করেছেন- সেই খবর। স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় প্রকাশ পেতে থাকে আসামির ক্যাসিনোকান্ড কিংবা বহুগামিতার খবর। একইভাবে জালিয়াতি-প্রতারণা আর অর্থ আত্মসাত মামলায় সামনে চলে আসে মাদক ও ইয়াবা আসক্তির তথ্য। করোনা চিকিৎসায় প্রতারণার অভিযোগের মামলায় জানা যায়- আসামি জুয়ার আসরেরও মধ্যমণি।
এরকম অশ্রæতপূর্ব চাঞ্চল্য করত নানা তথ্যে চাপা পড়ে যায় অপরাধীর আসল অপরাধ। মামলার তদন্ত মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। দেশবাসীর দৃষ্টি সরে যায় অন্য দিকে। ফাঁকে হয়তো আসামিও গ্রহণ করেন এই সুবিধা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য হয়তো সত্য কিংবা মিথ্যা। কিন্তু ক্ষতিটা হচ্ছে, এজাহারে উল্লেখিত মূল অপরাধকে গুরুত্ব না দিয়ে অভিযুক্তের অন্য বিষয় বেশি প্রচার পেলে নানামাত্রিক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। অতিরঞ্জিত তথ্যে তদন্ত প্রভাবিত হতে পারে। তদন্ত কর্মকর্তা এবং মানুষের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত হতে পারে। অপরাধী বড় ধরনের অপরাধ করেও তদন্ত এবং বিচারে পার পেয়ে যেতে পারে। যা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং ন্যায়বিচারের পথে অন্তরায়।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত : ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ধানমন্ডির নিজ বাসা থেকে নিখোঁজ হন কবি, প্রাবন্ধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার। তার স্ত্রী ফরিদা আখতার সন্দেহ করেন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাকে অপহরণ করে থাকতে পারেন। কিন্তু পরদিন ৪ জুলাই ১৮ ঘণ্টা পর তাকে উদ্ধার করা হয় সীমান্তবর্তী জেলা শহর যশোর থেকে। তাকে ‘অপহরণ’র ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়।
মামলাটির তদন্ত চলাকালে এক এক করে বেরিয়ে আসতে থাকে নারী ঘটিত চাঞ্চল্যকর তথ্য। তার প্রতিষ্ঠান ‘উবিনিগ’এ কাজ করতেন- এমন একজন নারীর সঙ্গে ফরহাদ মজহারের ‘রহস্যময় সম্পর্ক’ মুখ্য হয়ে ওঠে। মামলায় ওই নারীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। প্রচার হয়, ওই নারীর জন্য টাকা সংগ্রহ করতেই তিনি ভোর ৫টায় বাসা থেকে কাউকে কিছু না বলে ‘নিরুদ্দেশ’ হন। চাপা পড়ে যায় ফরহাদ মজহার নিরুদ্দেশ হওয়ার রহস্য।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ৭ খুনের ঘটনা ঘটে। চাঞ্চল্যকর এ মামলার প্রধান আসামি সিদ্ধিরগঞ্জের নূর হোসেন। তার ভারত পালিয়ে যাওয়া, দেশে ফেরত আনা, গ্রেফতার পর্যন্ত বহু রোমাঞ্চকর তথ্য প্রচার হয়। এ সময় মামলায় উল্লেখিত হত্যাকান্ডের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তার জমি দখল, চাঁদাবাজি, অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ নানা বিষয়। যদিও এসব বিষয়ের বিচারে এখন অবধি নূর হোসেনের কোনো দন্ড হয়নি। কার্যকর হয়নি হত্যা মামলার রায়ও।
বিক্রয় নিষিদ্ধ গাড়ির মালিকানা অর্জনের অভিযোগে গতবছর ১৭ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মুসা বিন শমসেরসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে। এ মামলার তদন্তের সময় মুসা বিন শমসেরের অবিশ্বাস্য বিলাসী জীবন যাপন এবং তাকে নিয়ে প্রচারিত গাল-গপ্পই মুখ্য হয়ে ওঠে সংবাদ মাধ্যমে। অথচ তার বিরুদ্ধে শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতির মাধ্যমে কার্নেট ডি প্যাসেজ সুবিধায় আনা বিক্রয় নিষিদ্ধ গাড়ি নিবন্ধন করে ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয় মামলায়। রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে ১০৪ নম্বর সড়কের ৫এ/বি নম্বর বাড়ি থেকে গাড়িটি জব্দ করেছিলো শূল্ক গোয়েন্দারা। ভুয়া আমদানি দলিলাদি দাখিল করে ‘ভোলা ঘ১১-০০-৩৫’ নম্বরের গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন নেয়া হয়েছিল।
ক্যাসিনোকান্ড নিয়ে হৈ চৈ পড়ে যায় সারা দেশে। প্রতিদিন একেকজন করে বাঘা বাঘা ব্যক্তি গ্রেফতার হন। খালেদা মাহমুদ, সম্রাট, জিকে শামীম, সেলিম প্রধান, পাপিয়া-এনু-রূপন- এমন প্রায় দুই শতাধিক নাম। মামলা দায়ের এবং গ্রেফতদারের পরপরই তাদের সম্পর্কে প্রচার হয় চাঞ্চল্যকর তথ্য। অথচ মূল মামলায় উল্লেখিত অপরাধের এসবের লেশমাত্র নেই। বর্তমানে রিজেন্ট সাহেদ, সাবরিনা, আরিফকে নিয়েও প্রচারিত হচ্ছে মুখ রোচক চাঞ্চল্যকর তথ্য। অথচ মূল মামলায় এসব উল্লেখ নেই। এমনকি তদন্তেও এসব তথ্য ঠাঁই পাবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
যেন বিচারের আগেই বিচার : এ বিষয়ে আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রচারের প্রতিযোগিতা থেকেই হয়তো বিষয়টি প্রথায় পরিণত হয়েছে। মূল ঘটনা রেখে শাখা-প্রশাখা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে প্রকৃত দোষী ব্যক্তির জন্য অনেক সময় সুবিধা নিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গণমাধ্যমে চাউর হওয়া এ প্রবণতা সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, এ প্রবণতা নানা দিক থেকেই ক্ষতিকর। এক দিকে মামলার বিচারের আগেই ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ হয়ে যাচ্ছে। যেটির দায়-দায়িত্ব অধিকাংশই মিডিয়ার। দ্বিতীয়ত: দায়ী আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রচারমুখিনতা।
তিনি বলেন, নিয়ম হলো আসামি গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে আগে আদালতে তোলা হবে। আদালতের নির্দেশে তদন্ত হবে। তদন্তের পর বিচার হবে। বিচারের পরই বলা যাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী কি নির্দোষ। কিন্তু ইদানিং বিষয়টির ব্যত্যয় ঘটছে। আমরা লক্ষ্য করছি, বিচারের আগেই বিচার হয়ে যাচ্ছে। বিচারাধীন কিংবা তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এতে অনেক বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। যা মামলার তদন্তকে প্রভাবিত করছে। বিচারেও অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এমনটি হওয়া উচিৎ নয়। এ বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। সেটিও উপেক্ষিত।
দায়িত্বশীল হওয়ার তাগিদ : সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ মনে করেন, আসামি গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা হতে পারে। কিন্তু সংবাদে চাঞ্চল্য আরোপের উদ্দেশ্যে আসামির বিশেষ কোনো বিষয়কে উদ্দেশ্যমূলক প্রচার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার মধ্যে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও কিছু দায়-দায়িত্ব রয়েছে। তারা তদন্তাধীন কিংবা বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন না। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। তদন্তও প্রভাবিত হয়।
তিনি বলেন, দেখা গেল গ্রেফতার হওয়া একজন আসামির নানা অপরাধের কথা মিডিয়ায় প্রচার করা হলো। কিন্তু বিচারের শেষে দেখা গেল তিনি বেকসুর খালাস পেলেন। তাতে তাকে ঘিরে যেসব তথ্য পরিবেশিত হয়েছে সব মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়। কিংবা প্রচারিত তথ্য অনুসারে বিচারটিই যথাযথ হয়নি- মর্মেও একটি ভুল বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছায়। তাই মামলায় উল্লেখিত ঘটনা বাদ দিয়ে মিডিয়ায় আসামির অন্যান্য বিষয় মুখ্য হয়ে উঠলে এটি তদন্ত, বিচার এমনকি বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার জন্যও ক্ষতিকর। এ বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং গণমাধ্যমকে আরও দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন