আগামিকাল পবিত্র ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। এই ঈদে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পশু কোরবানি করা প্রত্যেক সামর্থবান মুসলমানের জন্য ওয়াজিব। এ সময় ঘরে ঘরে গোশত ও গোশতের তৈরী ভূনা খিচুড়ি, কালিয়া, রেজালা, কাবাব সহ নানা মুখরোচক ও তৈলাক্ত খাদ্য বেশি খাওয়া হয়। রসনা তৃপ্ত করতে গিয়ে স্বাস্থ্যের কথা বেমালুম ভুলে গেলে চলবে না, দরকার শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর। খুশির ঈদ যাতে আমাদের একটু অসচেতনতায় নষ্ট না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
ঈদের আনন্দটুকু উদযাপনের জন্য আমাদের কিছু সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরি। যারা হার্টের রোগী বা রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশী তাদের গরুর বা খাসির গোশত অল্প পরিমাণে খাওয়া উচিত। যাদের মেদ ভুড়িঁ আছে, মোটা বা ওজন বেশি তারা অতিভোজন থেকে দূরে থাকবেন। কেননা অতিভোজন আপনার হার্টের সমস্যার কারণ হতে পারে। বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে অনেক সময় গোশত গিলতে এবং হজমে অসুবিধা হয় এবং অনেকের দাঁতের সমস্যা থাকে, তাদের প্রায়ই গোশতের টুকরা গলায় আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পরিবারের এমন বয়োজ্যেষ্ঠ থাকলে তাদের জন্য গোশতের টুকরা ছোট ছোট করে রান্না করতে হবে। করোনাকালে মানসিক ক্লান্তি, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা কাটিয়ে মনকে প্রফুল্ল ও চাঙা রাখতে ঈদ আনন্দ একটি দারুণ উপলক্ষ। তবে অহেতুক আতংকিত না হয়ে এবার বিশেষ সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা খুবই জরুরি। পরিবারের কারও একটু উদাসীনতা সকলের বিপদের কারণ হতে পারে। তা ছাড়া, কোরবানি ঈদে স্বাস্থ্য-সচেতনরাও হঠাৎ মুটিয়ে যেতে পারেন। সতর্ক থাকলে বাড়তি বিড়ম্বনা এড়ানো সম্ভব।
আমাদের সচেতনতার অভাবে, সুন্দর পরিবেশ ও আনন্দঘন ঈদের দিন পশুর রক্ত ও বর্জ্য পদার্থ দিয়ে অনেকেই রাস্তাঘাট, বাসা বাড়ির চারপাশ একেবারে দুর্গন্ধযুক্ত করে ফেলি। একটু সচেতন হলে এবং উদ্যোগ নিলে আমরা পরিবেশ দূষণরোধ এবং রোগ-জীবাণুর বিস্তার এড়াতে পারি। এছাড়া এবার যেহেতু কোরবানির ঈদ করোনা মহামারীকালীন সময়ে হচ্ছে তাই নিতে হবে বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কতা। যেমন:
১) কোরবানির কাজটি সম্পন্ন করতে অবশ্যই পরিষ্কার মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও শুরুর আগে-পরে সাবান পানি বা জীবনুনাশক লিকুইড ব্যবহার করতে হবে। তাহলে সংক্রমণের সম্ভাবনা একদম কমে যাবে।
২) কোরবানির স্থানে বেশি লোকসমাগম করা যাবে না। কোরবানির কাজে অন্যান্যবারের চেয়ে কমসংখ্যক সুস্থ্য মানুষ রাখুন ।
৩) কোরবানি শেষে কুসুম গরমপানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করুন ও গায়ের পোশাক ধুয়ে ফেলুন।
৪) নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানির পশু জবাই করতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি ঢেলে রক্ত পরিষ্কার করা প্রয়োজন। পশু কোরবানির রক্ত গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখা যায়। এ ছাড়া, যে জায়গায় গোশত কাটা হবে, সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
৫) কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে এক ভাগ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিতরণ করুন। এ বছর ভীড়বাট্টা পরিহার করা উচিত।
৬) প্রতিবারের মতো কোরবানির বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। কোরবানিকৃত পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের জন্য সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের সহায়তা করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচ্ছন্নতার দিকে একটু বিশেষভাবে তড়িৎ-তাৎক্ষণিক প্রদক্ষেপের দিকে নজর রাখতে হবে। পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে, ঈদুল আযহাকে আনন্দময় করতে এবং নিজের পাড়া-মহল্লাকে পরিচ্ছন্ন রাখতে আসুন সবাই যে যার অবস্থান থেকে এগিয়ে আসি।
ঈদের সময় দুটি রোগের প্রকোপ বেশী হয়। একটি হল ডায়রিয়া। এজন্য এসময় কিছু ওআরএস (ওরস্যালাইন) বাসায় রাখা দরকার। আর যদি পাতলা পায়খানার পরিমাণ বেশী হয় তবে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। অন্য সমস্যাটি হল গ্যাস্ট্রিক এসিডিটি বা পেপটিক আলসার ডিজিজ। এতে বুক জ্বালা, পেটে ব্যথা, বমির ভাব, টক ঢেকুর ইত্যাদি সমস্যা হতে পারে। গ্যাস্ট্রিক এসিডিটির সমস্যার জন্য কিছু এন্টাসিড ট্যাবলেট বা ওমিপ্রাজল/প্যান্টোপ্রাজল জাতীয় ঔষধ এবং ডমপেরিডোন (অমিডন) বাসায় রাখা উচিত। ঈদের রান্নায় মানহীন কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ ডালডা ও ঘি ব্যবহার যথাসম্ভব পরিহার করাই উচিত।
গরু ও খাসির গোশতে সবকটি প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো এসিড থাকে, তাই প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন পাওয়া যায়। গরুর গোশতে লৌহ ফসফরাস জাতীয় খনিজ লবণ বেশী পরিমাণ থাকে। গোশতের প্রোটিন উদ্ভিজ প্রোটিনের চেয়েও উন্নতমানের। কলিজা বা যকৃতের মধ্যে থাকে লৌহ। কলিজা খেলে বাড়ন্ত শিশুকিশোর ও মেয়েদের রক্তস্বল্পতা দূর হয়। ক্রনিক কিডনি রোগীর ক্ষেত্রে গরু ও খাসির মাংস যত সীমিত (চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুসারে পরিমাণমতো) খাওয়া যায় তত ভালো। যাদের রক্তে কোলেস্টেরল-এর পরিমাণ বেশী, রক্তনালীর ব্লক জনিত সমস্যা বা উচ্চ রক্তচাপ আছে তাদের মগজ এবং চর্বি পরিহার করা উচিত, কারণ গরুর বা খাসির মগজের মধ্যে একশ ভাগ কোলেস্টেরল থাকে। কখনোই পেট পুরে খাওয়া যাবে না। পেট ভরে ঢেঁকুর উঠার আগে খাওয়া বন্ধ করতে হবে। ঈদের আনন্দ যেন নষ্ট না হয় সে জন্য হৃদরোগীর হার্টের ঔষধ ছাড়াও যারা বিভিন্ন ক্রনিক রোগের (ডায়াবেটিস /উচ্চ রক্তচাপ) ওষুধ খাচ্ছেন সেগুলো মনে করে নিয়মিত খেতে হবে অর্থাৎ ডোজ যাতে মিস না হয়।
পরিশেষে বলি কোরবানির ঈদ বছরে একবারই আসে, এই ভেবে একসাথে বেশী না খেয়ে পরিমাণে অল্প অল্প করে বিভিন্ন সময়ে খাওয়া ভালো। এসময় খাবারের সাথে প্রচুর পরিমাণে সালাদ খাওয়া দরকার। ঈদের সময় পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করতে ভুলবেন না। এ সময় ইসবগুলের ভূষির শরবত খেলে কোষ্ঠ্যকাটিন্যের সমস্যা থেকে দূরে থাকা যাবে। ঈদের সময় ফলমূল ও সবুজ শাকসবজি খাবার তালিকা থেকে যেন বাদ না পরে।
ঈদে গোশত সংরক্ষণে ভুল ধারণার কারণে অনেক সময় টিনিয়া সোলিয়াম নামক পরজীবির সংক্রমণ ঘটতে পারে, ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি দেখা দেয়।তাই সঠিকভাবে কোরবানির গোশত সংরক্ষণ করা একটি জরুরি বিষয়। ফ্রিজে কোনওভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব না হলে উচ্চতাপমাত্রায় মাংস জ্বাল দিয়ে রাখতে হবে। অর্ধসিদ্ধ গোশত খাওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। কোরবানির গোশতে জীবাণুর সংক্রমণ হলে মারাত্মক অ্যান্টারাইটিস হতে পারে। এ রোগ পেটের এক ধরনের সংক্রমণ, যা খুবই ভয়াবহ। তাই সুস্থ্য ব্যক্তি দ্বারা গোশত কাটা, প্যাকেট করা এবং ফ্রিজে রাখার ক্ষেত্রে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করা দরকার।
সকল রোগ প্রতিরোধে সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তাই নিজের এবং পরিবারের প্রতি যত্নশীল হই। ঈদ সবার জন্য বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। সবাইকে কোলাকুলিহীন আরেকটি ঈদের অগ্রিম শুভেচ্ছা।
ডা: মো: আব্দুল হাফিজ শাফী
নাক-কান-গলা বিভাগ,
বি.এস.এম.এম.ইউ (প্রেষণে), ঢাকা।
drhafiz_33@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন