বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনশন ও অন্যান্য আর্থিক বৈষম্য নিরসন করা হোক

মো. মোসলেম আলী মোল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ৮ আগস্ট, ২০২০, ১২:০২ এএম

সরকারি কর্মচারীরা চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর পেনশন পেয়ে থাকেন। তারা সমাজে প্রবীণ বলে পরিচিত। অতীব দুঃখের বিষয় এই প্রবীণরা কীভাবে জীবন যাপন করছেন তা অনেকেই জানেন না। এহেন পরিস্থিতিতে সরকার কর্মরতসহ অবসরপ্রাপ্তদের জীবনমান উন্নয়নে কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। তবে এগুলির মধ্যে কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে, যার আশু অবসান কাম্য।

পেনশনার বনাম পেনশনার: বিগত সময়ের পে-কমিশনের মাধ্যমে কর্মরতদের বেতন ভাতা এবং পেনশনারদের পেনশন যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে পেনশনারদের পেনশনের আনুপাতিক হার অধিক পরিমাণে কমে গেছে। অপরদিকে একই পদে কর্মরত সিনিয়র, যিনি আগে অবসর নিয়েছেন তার পেনশন পরবর্তীতে অবসরপ্রাপ্ত জুনিয়রদের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে গেছে। উদাহরণ সরূপ বলা যায়, সর্বোচ্চ পদে কর্মরত যারা যথাক্রমে ২০০২, ২০০৬, ২০১০ ও ২০১৬ সালে অবসরে গেছেন, ২০১৭ সালে তাদের পেনশনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৬৮৭৫, ২০৭০০, ২৪০০০ এবং ৩৬৯০০ টাকা। অর্থাৎ প্রথম অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণতম ব্যক্তিটির বর্তমান পেনশন সর্বশেষ অবসর প্রাপ্ত ব্যক্তির প্রাপ্ত পেনশনের অর্ধেকেরও কম (৪৫.৭৩%)।
কর্মরত বনাম পেনশনার: একই পদে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্তদের আয় বৈষম্য দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন ২০০২ সালে সর্বোচ্চ পদে কর্মরত একজনের বেতন ছিল ১৫০০০ টাকা। ঐ সনে একই পদের একজন অবসর গ্রহণের ফলে তার নিট পেনশন হয় ৬০০০ টাকা। অর্থাৎ একই সময় একই পদে কর্মরত এবং অবসর গ্রহণকারীর আয়ের আনুপাতিক হার ১০০:৪০। পরবর্তীতে ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৫ সালে পে-কমিশনের পর উভয়ের বেতন/পেনশন বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধির ফলে ২০০৫, ২০১০ এবং ২০১৬ সালে কর্মরতদের বেতন হয় যথাক্রমে টাকা ২৩০০০, ৪০০০০ এবং ৮২০০০। অপরদিকে, অবসরগ্রহণকারীর পেনশন হয় যথাক্রমে ৭৫০০, ১১২৫০, এবং ১৬৮৭৫ টাকা। ফলে একই পদের কর্মরত/অবসরপ্রাপ্তের আয়ের অনুপাত ১০০:৪০ হতে কমে যথাক্রমে ১০০:৩২.৬০, ১০০:২৮.১২ এবং ১০০:২০.৫৮ এ নেমে আসে। যে অনুপাত বর্তমান হিসাবে ১০০:৪৫ হওয়া যুক্তিসংগত ছিল। অর্থাৎ পেনশনারদের পেনশন বৃদ্ধির হার যুক্তিসংগত না হওয়ায় তারা বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের দুরাবস্থা: ক) জুলাই-২০০২, ২০০৮, এপ্রিল-২০১০ এবং জানুয়ারি-২০১৪ সালে অবসরপ্রাপ্ত এবং শতভাগ পেনশন সমর্পণকৃত প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদের কয়েকজন কর্মচারীর পেনশন পরবর্তী প্রাপ্ত/বঞ্চিত সুবিধাদি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ১২ বছর বা তৎপূর্বে অবসরপ্রাপ্ত সর্বোচ্চ পদের একজন ১২ হতে ১৮ লক্ষ টাকা গ্র্যাচুয়িটি পেয়েছেন (যা এখন প্রায় পঁচাশি লক্ষ)। যা দিয়ে সে সময় কোনো জেলা শহরেও একটা ভাল বাড়ি হতো না। আবার অবসরের পরও অনেকের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, মেয়ের বিয়ে, পরিবারের কোনো ব্যক্তির জটিল রোগের চিকিৎসার দায় রয়ে যায়। আমার বিশ্বাস, অধিকাংশ জনই অনুরূপ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শতভাগ পেনশন সমর্পণে বাধ্য হয়েছেন। খ) আবার শতভাগ পেনশন সমর্পণ করে এককালীন ১০০ মাসের নিট পেনশনের সমান ৬ বা ৯ লক্ষ টাকা পেয়েছেন। বর্তমানে সরকার অবসরের ১৫ বছর পূর্তির পর পেনশন পুনঃ প্রদানের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। হিসাবে দেখা যায়, এতে একেকজন ২৯৬ হতে ৩৬৯ মাসের নিট পেনশনের সমান অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বর্তমান সরকার কর্মচারীদের বিনা সুদে গাড়ি ক্রয় এবং অর্ধেক সুদে বাড়ি নির্মাণের ঋণ প্রদানের এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছে। পূর্বে উল্লেখিত অবসরপ্রাপ্ত যারা এককালীন যে অর্থ পেয়েছেন তার পরিমাণ গাড়ি/বাড়ি নির্মাণ ঋণের তুলনায় অতি নগন্য। কাজেই অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ এই ব্যক্তিদের প্রাপ্ত অর্থ যদি গাড়ি/বাড়ি ঋণ প্রাপ্তদের ন্যায় একই হারে পরিশোধের পর (প্রাপ্ত অর্থ থেকে বঞ্চিত হওয়াকে পরিশোধগন্য করে) তাদের পেনশন পুনঃস্থাপন বিবেচনা করা হয়, সেক্ষেত্রে তারা যথাক্রমে ছয় হতে সাড়ে ছয়/সাত হতে সাড়ে সাত বছর পর পেনশন পুনঃস্থাপনের যোগ্য। এমনকি যদি ১৫ বছরের নিট পেনশনের সমপরিমাণ অর্থ প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিতের পরে পুনঃ পেনশন দেয়া হতো তাতেও অবসরের ১০ বছর পর পুনঃ পেনশন পাওয়ার যোগ্য। (সচিবগণ সর্বোচ্চ এবং নির্ধারিত বেতনভুক্ত বিধায় হিসাবের সুবিধার্থে তাদের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে। নিম্নপদের কর্মচারীদের অবস্থা তুলনামূলক আরো শোচনীয়।)

গ) শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীরা প্রথম থেকেই চিকিৎসা ভাতা পেয়ে আসছেন। পরবর্তীতে ২০০৮-২০০৯ অর্থ বছরে অর্ধেক এবং তার পরের বছর হতে পূর্ণ উৎসব ভাতা পেয়ে আসছেন। আমার জানা মতে, উক্ত ভাতাসমূহ বেতন/পেনশনের সাথে সম্পৃক্ত। কাজেই যে পেনশন পায় না সে ভাতা পাবে কেন? এর কারণ আমার মনে হয়, পেনশন সমর্পণকারীরা নিট পেনশন সমর্পণ করলেও কোনো ভাতা সমর্পণ করেননি। আবার বিভিন্ন সময় সরকার পেনশন বৃদ্ধি করেছেন কিন্তু সমর্পণকারীরা তা হতে বঞ্চিত। কিন্তু অবসর সময়ে নিট পেনশন সমর্পণ করে তার একশত গুণ অর্থ এককালীন পেয়েছেন। পরে পেনশন বৃদ্ধি করা হলে তা তারা সমর্পণ করেননি এবং এর বিনিময়ে কোনো অর্থও পাননি। আমি মনে করি, যে যুক্তিতে কর্তৃপক্ষ পেনশন সমর্পণকারীদের চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা প্রদান করছেন, একই যুক্তিতে বর্ধিত পেনশনও তাদের প্রাপ্য।

চিকিৎসা ভাতা: সরকারি কর্মচারীরা চাকরি এবং অবসরকালীন উভয় সময়ে চিকিৎসা ভাতা পেয়ে থাকেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে সকলেরই চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে প্রবীণ ব্যক্তিদের অধিকাংশই হৃদরোগ, কিডনি, ফুসফুস, বাত, ডায়েবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এমতাবস্থায়, কর্তৃপক্ষের নিকট নিবেদন, সকল স্তরেই চিকিৎসা ভাতা যুক্তিসঙ্গত হারে বৃদ্ধি এবং অধিক বয়জ্যেষ্ঠদের ক্ষেত্রে চিকিৎসা ভাতার আর দু-একটা ধাপ নির্ধারণ করে অধিকহারে চিকিৎসা ভাতা প্রদান করা প্রয়োজন।

পারিবারিক পেনশন: আর একটি বিষয়ে আমরা অনেকেই ভীষণ উদ্বিগ্ন, তা হচ্ছে পারিবারিক পেনশন। অর্থ বিভাগের ২৮/১০/২০১৯ তারিখের প্রজ্ঞাপনের মর্মানুযায়ী শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীর পেনশন পুনঃস্থাপনের পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে তার পরিবার পেনশন সুবিধা পাবেন না। এটা যাদের এখনও পেনশন পুনঃস্থাপন হয়নি তাদের জন্য চরম দুশ্চিন্তার বিষয়। এমনিতে প্রবীণরা নানান জটিল রোগে রোগাক্রান্ত, তার উপর এমন দুশ্চিন্তা তাদের জীবনের জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এমতাবস্থায়, শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী পেনশন পুনঃস্থাপনের পূর্বে মৃত্যুবরণ করলে, জীবিত থাকলে যখন পেনশন পুনঃস্থাপন হতো তখন হতে তার পরিবারকে (যদি থাকে) পেনশন দেওয়া প্রয়োজন।

আমরা অবসরপ্রাপ্তরা অধিকাংশজনই খুব কষ্টে দিনাতিপাত করছি। এমতাবস্থায়, আমাদের দুর্দশা বিবেচনা করে অবসর ভাতা/চিকিৎসা ভাতা যুক্তিসঙ্গত হারে বৃদ্ধি, শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের পেনশন যুক্তিসঙ্গত সময় পর পুনঃস্থাপন এবং পারিবারিক পেনশনপ্রাপ্তির শর্ত পুনঃবিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত উপ-সচিব, ৩২/৩৩, বনলতা বাণিজ্যিক এলাকা, সপুরা, শাহমখদুম, রাজশাহী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
মনির হোসেন মোল্লা ১৮ অক্টোবর, ২০২০, ১:৪৬ এএম says : 0
বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর ও যুক্তিযুক্তভাবে বর্নিত হয়েছ। লেখককে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাচ্ছ। সদাশয় সরকার কর্তৃক বিবেচিত হবে বলে আশা রাখি।মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।
Total Reply(0)
rita ২৯ অক্টোবর, ২০২০, ১২:১২ এএম says : 0
আমার বাবা একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। তিনি শতভাগ পেনশন নেয়ার পর ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল মারা যান। উনার ছেলে মানসিক প্রতিবন্দী। উনার পরিবার কষ্টের মধ্যেে আছে।উনার পেনশন পুনঃস্থাপনের জন্য মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি।
Total Reply(0)
নূর মোহাম্মদ কামাল ২৫ নভেম্বর, ২০২০, ৯:১৯ এএম says : 0
আমি বিগত ২০০৫ সালের ০৩, জানুয়ারী তারিখে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অবসর অবসর গ্রহন করেছি। ১ বছর পিআরএল সমাপ্তীর পর ২০০৬ এর জানুয়ারী থেকে আমার পেনশন শুরু হয়। আমি শতভাগ পেনশন সমর্পন করেছি। এখন আমি বুঝতে পারছি না, আমার পেনশন পূনঃস্পান জানুয়ারী, ২০২০ এ হবে না জানুয়ারী ২০২১ হবে। সহৃদয় ভুক্তভুগীরা কেউ জানালে বিশেষ উপকৃত হব।
Total Reply(0)
শিহাবুজজামান ১০ আগস্ট, ২০২১, ৯:৪১ পিএম says : 0
আসসালামুআলাইকুম,আমার পিতা একজন শতভাগ পেনশনভোগী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ছিলেন,তিনি ২০০২ সালে ১ জুন অবসরগ্রহন করেন। তিনি ২০১৮ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী মৃত্যু বরন করেন, মুমূর্ষু রোগী অবস্থা পেনশনপুনঃসঃাপন করতে পারেন নি, শতভাগপেনশনভোগী গেজেট হয়েছে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে, কিন্তু আমার পিতা পেনশনভোগী মা কি পুনঃ পেনশনের আবেদন জানাচ্ছ, মাননীয়প্রধানমন্ত্রী কাছে,মা কে পুনঃপেনশনের আওতায় আনার জন্য কর জোরেে আবেদন করছি,
Total Reply(0)
শিহাবুজজামান ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১:২৬ এএম says : 0
অবসর যাওয়ার ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলে কেন নমিনীর নামে পেনশন পুনঃ পেনশন পাবে না,,, সরকারি গেজেট অনুযায়ী পাওয়ার যোগ্য
Total Reply(0)
Adv Muntakim Chowdhury ২৩ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৪৭ এএম says : 0
জাতীয় বেতনস্কেলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের পেনশন বৈষম্য দুর করে একটি গ্রহণযোগ্য সমতা আনয়নের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আনা উচিত।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন