দীর্ঘ ৮৬ বছর পর আয়া সোফিয়া থেকে ধ্বনিত হলো আযানের ধ্বনি- ‘আল্লাহু আকবার’-আল্লাহ সবচে বড়...; ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই। এর চেয়ে সত্য ও যথার্থ কথা আর কী আছে? আল্লাহ্ই সবচেয়ে বড় এবং আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই। আমাদের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা মহান আল্লাহর বড়ত্ব সম্পর্কে বারবার আমাদের সচেতন করছে। এরপরও মানুষ তা ভুলে যায়, গর্ব-অহঙ্কারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আত্মগর্বী মানুষ নিজেকেই মনে করে সবচেয়ে বড়। অথচ তার চারপাশের এই বিশ্বেও সে কত ক্ষুদ্র এক প্রাণী। কত সামান্য তার আয়ু, কত অল্প তার ক্ষমতা। আর এটুকুও তার মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার দান। এই ক্ষুদ্র মানুষ যখন ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি বন্ধ করার চেষ্টা করে তখন এর চেয়ে ঘৃণ্য বিষয় আর কী হতে পারে?
এই ভ‚মি আল্লাহর। এই আকাশ-বাতাস আল্লাহর। তাই এটাই তো স্বাভাবিক যে, এখানে একমাত্র আল্লাহ্কেই সিজদা করা যাবে, অন্য কাউকে নয়। এখানে একমাত্র আল্লাহর নামই উচ্চারিত হতে হবে, অন্য কারো নয়। কিন্তু আল্লাহতাআলা যেহেতু পৃথিবীর এই জীবনকে মানব-জাতির পরীক্ষার জীবন করেছেন তাই এখানে মানুষকে কিছুটা স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে; সত্য-অসত্য এবং ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা। আর সে কারণেই মানুষকে প্রকৃতির অন্যান্য বস্তুর মতো সুনির্দিষ্ট নিয়মে বেঁধে দেয়া হয়নি। মানুষ স্বেচ্ছায়-সাগ্রহে একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করুক, এক আল্লাহ্কেই সিজদা করুক, সৃষ্টিজগতের সবকিছুকে আল্লাহর সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করে তাঁরই অনুগত থাকুক, তার যা কিছু সক্ষমতা ও স্বাধীনতা তা সে সত্য-ন্যায়কে গ্রহণ করার ক্ষেত্রেই ব্যয় করুক- এটাই তো এখানে মানুষের কর্তব্য।
আল্লাহর কাছে ভ‚পৃষ্ঠের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা মসজিদ। মুমিন বান্দার কাছেও তাই। মসজিদের সাথে মুমিনের হৃদয়ের বন্ধন। জান্নাতী মানুষের এক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার অন্তর মসজিদের সাথে যুক্ত থাকে। মসজিদ তার প্রশান্তির জায়গা। আর তাই আল্লাহভীরু মুমিন বান্দাদের মাধ্যমে মসজিদসমূহ আবাদ থাকে।
মসজিদ হচ্ছে মুমিন-জীবন ও মুসলিম-সমাজের তাপকেন্দ্র। এখান থেকে গোটা সমাজে ঈমানের আলো ও উত্তাপ সরবরাহ হয়। মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত জীবন ও বসতি আসমানী আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সুস্থ-সুন্দর বোধ-বিশ্বাস, নির্মল ও নিষ্কলুষ কর্ম ও আচরণের ক্ষেত্রে মসজিদের প্রভাব অপরিসীম।
ইসলামী জীবনধারার বিস্তার এবং মুসলিম-সমাজের সুস্থতা ও সক্ষমতার ক্ষেত্রে মসজিদের এই প্রভাবের কারণে তা সবসময় ওইসকল মানুষের চক্ষুশূল, দুর্ভাগ্যজনকভাবে শয়তান যাদের বিপথগামী করে দিয়েছে। ফলে আল্লাহর ভ‚মিতে আল্লাহর ইবাদতে বাধা দেয়ার মতো এবং আল্লাহর ঘর মসজিদের দরজায় তালা দেয়ার মতো চরম অন্যায়, অযৌক্তিক ও গর্হিত কাজও তাদের কাছে বৈধ ও যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়েছে। একেই বলে অন্তরের অন্ধত্ব। এ ধরনের বিষয়গুলোই হচ্ছে শয়তানের ‘সুশোভিতকরণ’-এর দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাআলা যদি নিজ অনুগ্রহে কাউকে এই বিপদ থেকে রক্ষা না করেন তাহলে তার রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
অতীত-বর্তমানের কত দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে। আল্লাহর সৃষ্টি ক্ষুদ্র মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রবৃত্তির প্ররোচনায় পড়ে স্বয়ং আল্লাহতাআলার সাথেই বিদ্রোহ করেছে। নিজেকে সে অজেয়-অপ্রতিরোধ্য মনে করেছে। কিন্তু সামান্য কালের ব্যবধানে সবকিছুই ধুলোয় মিশে গেছে। বাস্তব জীবনে তার সকল কীর্তি ধুলোয় মিশে গেলেও তা থেকে গেছে ইতিহাসের পাতায় এবং তার নিজের আমলনামায়। যে আমলনামা নিয়ে একদিন তাকে দাঁড়াতে হবে মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলার সামনে।
তুরস্কের আয়া সোফিয়া মসজিদকে কেন্দ্র করে আবারো স্থাপিত হলো সেই একই দৃষ্টান্ত। আল্লাহর ঘরে তালা দেয়া ও তালা খোলার দুই ঘটনার মধ্যে ব্যবধান মাত্র ৮৬ বছরের। মানবজাতির ইতিহাসের সময়-পরিক্রমায় এই সময়টা কিছুই নয়। ৮৬০ বছরের ব্যবধান হলেও তা হতো মহাকালের তুলনায় অতি নগণ্য।
এখানের মানবসমাজের দুই শ্রেণির জন্যই বার্তা আছে; সৌভাগ্যবানদের জন্যও আছে, দুর্ভাগাদের জন্যও আছে। সৌভাগ্যবান মুসলিম, যারা আল্লাহর হুকুম মোতাবেক চলেন এবং সমাজে আল্লাহর হুকুম পালনের বিস্তার ঘটুক- এই আকাক্সক্ষা পোষণ করেন; তাদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, দাওয়াত ফী সাবীলিল্লাহর ক্ষেত্রে হতাশ না হওয়ার।
চারপাশের ইসলামবিরোধী, ইসলাম বিদ্বেষী ও ইসলাম সম্পর্কে নির্লিপ্ত মানুষের সংখ্যাধিক্য দৃষ্টে ভীত-সন্ত্রস্ত না হওয়ার। দাওয়াতের তাৎক্ষণিক সুফল দৃশ্যমান না হওয়ায় হতোদ্যম না হওয়ার। মানুষের দুনিয়ার জীবন যেমন ক্ষণস্থায়ী, চারপাশের ইসলামবিরোধীদের নর্তন-কুর্দন তার চেয়েও বেশি ক্ষণস্থায়ী। এইসবে প্রভাবিত না হয়ে দায়ীর কর্তব্য, শরীয়তের নীতি ও বিধান সঠিকভাবে মেনে সে অনুযায়ী দাওয়াতের কাজে মশগুল থাকা। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার ঘোষণাটি সত্য, ‘পরিণাম তো মুত্তাকীদেরই’। (সূরা আ’রাফ : আয়াত ১২৮)। আল্লাহ আরও বলেন, ‘হতোদ্যম হয়ো না, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না, তোমরাই তো বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৩৯)।
অন্যদিকে দুর্ভাগা মানব-সন্তান, যাদের কাছে আল্লাহর হুকুমের বিরোধিতা যুক্তিসঙ্গত মনে হয়, যাদের মনে মহান আল্লাহর ইবাদতের স্থানগুলোকে শেকল পরানোর দুঃসাহস জাগে আর সমাজে এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতার বিস্তারের জন্য নানাবিধ যুক্তি ও দর্শনের উদ্ভাবন ও চর্চাকে যারা শিক্ষা-বিস্তার বলে মনে করেন, তাদের জন্য বার্তা এই যে, তাদের এইসব অপতৎপরতাও নিতান্তই অসার ও ক্ষণস্থায়ী।
আল্লাহর ঘরে শেকল পরাতে পেরে যতই তারা অট্টহাসিতে নরক-গুলজার করুন, এই অশুভ অট্টহাসি খুবই অল্পসময়ের, যেটুকু সময়ের অবকাশ এই জাহানের সৃষ্টিকর্তা তাদের দিয়েছেন। এই সময়টুকু যখন শেষ হবে তখন তাদের নিজেদের কর্মই তাদের জন্য টেনে আনবে অনিঃশেষ কান্না ও লাঞ্ছনা। আখিরাতের চরম লাঞ্ছনা ও মর্মন্তুদ যাতনা তো আছেই, দুনিয়াতেই তাদের কর্ম তাদেরকে পরিণত করবে চরম ঘৃণার পাত্রে। এর অসংখ্য দৃষ্টান্ত ইতিহাসের পাতায় ছড়িয়ে আছে।
কাজেই মানুষ মাত্রেরই কর্তব্য, চিন্তা-শক্তিকে শুভ-অশুভের পার্থক্যের ক্ষেত্রে কাজে লাগানো। ব্যক্তি ও সমাজের স্রষ্টা, এই জগৎ-মহাজগতের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কাছে নতশীরে ফিরে আসা, জীবন ও কর্মের গতিপথ আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া। মহান আল্লাহ যে মেধা ও কর্মশক্তি দান করেছেন তা তাঁরই আনুগত্য গ্রহণ ও বিস্তারের ক্ষেত্রে ব্যয় করা।
মাত্র এক শতকেরও কম সময়ের ব্যবধানে আয়া সোফিয়া মসজিদে যে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে তা থেকে আমরা যেন শুভ ও কল্যাণের শিক্ষা নিতে পারি- মহান আল্লাহ তাআলার কাছে এটাই প্রার্থনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন