ইতিহাসে হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফকে নিষ্ঠুর শাসক হিসেবে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। উমাইয়া আমলের এ শাসনকর্তার অত্যাচার-নির্যাতনের বহু কাহিনী ইতিহাসে উল্লিখিত আছে। খলিফা আবদুল মালেকের পক্ষ হতে তিনি ইরাকের গভর্নর ছিলেন। এখানে আমরা হাজ্জাজের শাসননামলের এমন দুইটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই, যার একটি তাফসীর গ্রন্থে ও অপরটি ভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দু’টি ঘটনাই দোয়া কবুল হওয়া না হওয়া সম্পর্কিত। প্রথম ঘটনাটি খরা ও দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে, যা সংক্ষেপে এই:
দেশে দীর্ঘমেয়াদি খরা ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। খরা কবলিতদের দুর্দশা, দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করে। সর্বত্র মানুষের মধ্যে হাহাকার দেখা দেয়। হাজ্জাজ ‘ইস্তেস্কার’ নামাজ (বৃষ্টির জন্য নামাজ) আদায়ের কথা ঘোষণা করেন এবং আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের সকল লোকের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করেন। এই জন্য স্থান ও সময় নির্দিষ্ট করা হয়। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী যথা সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে সবাই উপস্থিত হন।
হাজ্জাজ ঘোষণা করেন, ‘ইস্তেস্কা’ নামাজের ইমাম হবেন এমন এক ব্যক্তি, যার ওপর আছরের নামাজ ফরজ হওয়ার পর একবারও কাজা হয়নি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর একজনকেও পাওয়া গেল না ইমাম হিসেবে অগ্রসর হতে। নিরাশ হয়ে অবশেষে হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফ নিজেই ‘ইস্তেস্কার’ নামাজে ইমাম হিসেবে দাঁড়ান এবং বৃষ্টির জন্য দোয়া, মোনাজাত করেন। বলা হয়, হাজ্জাজের মোনাজাত শেষ হতে না হতেই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। হাজ্জাজের আসরের নামাজ কখনো কাজা হয়নি বলেই তিনি কাউকে না পেয়ে নিজেই ‘ইস্তেস্কার’ নামাজ পরিচালনা করেছিলেন বলে ইতিহাসের তথ্য।
অপর ঘটনাটি ভিন্ন প্রকৃতির, যা ধর্মীয় গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তাও দোয়া সংক্রান্ত। বলা হয় যে, হাজ্জাজ ইবনে ইউসূফ যখন ইরাকের গভর্নর হিসেবে সেখানে গমন করেন, অনুধাবন করতে পারেন যে, ইরাকীরা তাকে পছন্দ করে না, সেখানে শাসনকার্য পরিচালনা করা খুব সহজ হবে না, তাছাড়া সেখানে এমন এক আল্লাহভক্ত ‘আওলিয়া দল’ রয়েছে যে, কোনো ব্যাপারে দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল হয়। তারা যদি হাজ্জাজের বিরোধী হয়ে যান তাহলে জনগণ বাধ্য থাকবে না, বিরোধী হয়ে যাবে। হাজ্জাজ অনেক চিন্তা ভাবনার পর একটি কৌশল স্থির করলেন। সেখানকার সকল অধিবাসীকে খাবারের দাওয়াত করবেন এবং তাতে আওলিয়া দলকে আমন্ত্রণ জানাবেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় গণদাওয়াতের আয়োজন করা হয় এবং নির্ধারিত সময়ে সবাই দাওয়াতে অংশগ্রহণ করেন। হাজ্জাজ উপস্থিত সকলকে স্বাগত জানান এবং খাবার পরিবেশনে তদারকি করেন, সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে আওলিয়া দলকে খাবার পরিবেশন করা হয়। এতে হাজ্জাজ খুবই সন্তুষ্ট হন এবং খাবারে অংশগ্রহণ করায় সবাইকে সাধুবাদ জানান, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
আলোচনা প্রসঙ্গে হাজ্জাজ বলেন, এখন তিনি নিশ্চিন্ত, আওলিয়ারা বদদোয়া করলেও তাতে তার কোনো ক্ষতি হবে না। কেননা বদদোয়ায় ক্ষতির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের বদদোয়া কবুল হবে না। কারণ খাবারের মধ্যে হারাম বস্তু মিশিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং আওলিয়া দলের পেটে তা প্রবেশ করেছে, তারা টেরও পাননি যে খাদ্য হারাম ছিল। হাজ্জাজ প্রতারণার মাধ্যমে আওলিয়া দলকে হারাম খাদ্য ভক্ষণ করিয়েছেন সে জন্য তার পাপের দায়ী তিনিই, কিন্তু যারা হারাম খাদ্য গ্রহণ করেছেন, তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া তাদের দেহে থাকবে, তাদের দোয়া-এবাদত-বন্দেগী কিছুই কবুল হবে না।
আমাদের দেশের প্রতি তাকালে দেখা যাবে যে, এক শ্রেণির লোক এই ভয়াবহ করোনা, বন্যাকবলিত মারাত্মক পরিস্থিতিতেও আল্লাহকে ভয় করছে না। লুটপাট, আত্মসাৎ, ভেজাল, প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, চোরাকারবারি, খুন-খারাবি, হত্যাকান্ডসহ নানা ঘৃণ্য অপরাধকর্মের সাথে তারা জড়িত। সঙ্কট ও বিপর্যয়গুলোকেও বিন্দুমাত্র ভয় করছে না। তারা সমাজবিরোধী, নৈতিকতাবিরোধী এবং চরিত্রহননকারী কর্মকান্ডে লিপ্ত। অনুরূপ আরো বহু গর্হিত কর্মকান্ড অহরহ প্রদর্শিত হচ্ছে। এই শ্রেণির লোকদের বেপরোয়া কার্যকালাপ বন্ধ না হলে আল্লাহর গজব আরো দীর্ঘস্থায়ী হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন