দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউওনও) ওয়াহিদা খানমের জ্ঞান ফিরেছে তবে শঙ্কামুক্ত নন। তবে তিনি স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু সরকারি বাসায় উপজেলা পরিষদের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। প্রশাসন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সর্বত্রই চলছে এ নিয়ে আলোচনা। একই সঙ্গে রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের তিনজন হামলার কথা স্বীকার করেছেন। কক্সবাজারে মেজর (অব) সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনার স্বীকারোক্তি আদায়ে যখন তিন দফা রিমান্ডে নিয়ে এক মাস সময় লাগে; তখন একদিনেরই ইউএনও’র ওপর হামলার স্বীকারোক্তি আদায় করা নিয়ে ঘোড়াঘাট উপজেলা, দিনাজপুর-রংপুরসহ সর্বত্রই চলছে আলোচনা। হামলাকারীরা স্বীকার করেছেন, চুরি করার জন্য তারা ইউএনও’র ঘরে প্রবেশ করেছেন। সত্যিই কী শুধু চুরি করার জন্য ইউএনও’র বাসায় গেছেন? সিসি ক্যামেরা বেষ্টিত ইউএনও’র বাসায় ভেন্টিলেটার ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করেন; অতপর হাতুড়ি দিয়ে ইউএনওকে গুরুতর জখম ও রক্তাক্ত করার পর তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলীকে কুপিয়ে সেখান থেকে নির্বিঘ্নে চলে যান! সত্যিই কী হিসেব এতো সহজ? নাকি এর ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে গুরুত্বর কোনো গোপন রহস্য? ক্ষমতাসীন দলের ভিতর এবং প্রশাসনের অভ্যন্তরে কোনো গোপন রহস্য লুকিয়ে নেই তো? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে সন্দেহের শাখা-প্রশাখা ডালপালা ছড়াচ্ছে।
সরকারি বাসভবনে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুত্ব আহত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনায় যুবলীগের তিন নেতাসহ ছয়জনকে আটক করেছে আইন-শৃঙ্খাবাহিনী। গতকাল শুক্রবার পৃথক অভিযানে তাদের আটক করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন দায় স্বীকার করায় বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে তারা চুরির উদ্দেশ্যে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানায় র্যাব।
এদিকে ঢাকায় ওয়াহিদা খানমের মাথায় সফলভাবে অস্ত্রোপচার করেছেন চিকিৎসকরা। গত বৃহস্পতিবার রাতে টানা দুই ঘন্টা অস্ত্রোপচারে তার মাথায় ভাঙা হাড়ের আট টুকরা জোড়া দেয়া হয়। অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘন্টা পরই জ্ঞান ফিরে তার। গতকাল স্বামী ও চিকিৎসকদের সাথে কথাও বলেছেন তিনি। পরে তাকে হাসপাতালের আইসিইউতে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। সেখানে ৭২ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে থাকার পর পরবর্তী সিন্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে গতকাল এ প্রতিবেদন লেখার সময় চিকিৎসকরা জানান, ইউএনও ওয়াহিদার সব প্যারামিটার খুবই ভালো। সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট কেমন আসে, সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। তবে ভালো খবর, তার সিটি স্ক্যানের রিপোর্ট শতভাগ ভালো এসেছে।
এছাড়া চিকিৎসাধীন ওয়াহিদা খানমের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা আজ (শনিবার) বৈঠক করার কথা রয়েছে। এ সময় তার শারীরিক অবস্থা পর্যাবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্স হাসপাতালের নিউরো ট্রমা বিভাগের প্রধান নিউরোসার্জন ও গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান মোহাম্মদ জাহিদ হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ছয় সদস্যবিশিষ্ট চিকিৎসক দলের প্রায় দুই ঘন্টার চেষ্টায় ইউএনও ওয়াহিদার মাথার জটিল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হয়েছে। এখনই তার শারীরিক অবস্থার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। তাকে ৭২ ঘন্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আজ আমাদের মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বসবেন, এরপর এ বিষয়ে চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেবেন।
ডাক্তার জানান, অস্ত্রোপচারের সময় ওয়াহিদার মাথায় দেখা যায় ৮ থেকে ৯টি আঘাতের চিহ্ন। সেগুলো পরিষ্কার করে সেলাই দেওয়া হয়। এছাড়া এ আঘাতের কারণে মস্তিষ্কের বিভিন্নস্থানে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল সেগুলোও পরিষ্কার করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, লোহা জাতীয় কোনো জিনিস দিয়ে ইউএনও ওয়াহিদা মাথায় এলোপাথারি আঘাত করা হয়েছে। যারা আঘাত করেছে তারা মনে করেছেন তার মৃত্যু হয়েছে। ওয়াহিদাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এ আঘাতগুলো করা হয়েছিলে বলে জানান ওই চিকিৎসক।
ইউএনও ওয়াহিদা সেরে উঠবেন সে ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও শঙ্কামুক্ত নন বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী কিন্তু এটা হেড ইঞ্জুরির ব্যাপার, তার মাথার ভেতর রক্তক্ষরণ হয়েছে এবং ব্রেনে আঘাত লেগেছে। ব্রেনের ওপর একটা চাপ ছিল সেটা আমরা রিলিফ করেছি। তবে এখনই ক্লিয়ারলি আমরা বলতে পারব না যে রোগী ভালো হয়ে যাবে। তিনি বলেন, ইট উইল টেক টাইম। অন্তত ৭২ ঘন্টা আমরা তার পরিস্থিতি অবজার্ভ করব। আমরা আশাবাদী রোগী ভালো হয়ে যাবে, বাকিটা আল্লাহ ভরসা। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওনার ডান পাশটা যে অবশ ছিল, প্যারালাইজড। আশা করি সেটা রিভার্স হয়ে যাবে, সচল হয়ে যাবে। তবে কিছুদিন সময় লাগবে।
এর আগে গত বুধবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে দুর্বৃত্তরা সরকারি আবাসিক ভবনে ঢুকে ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপাতে শুরু করে। তার মাথা রক্তাক্ত করে। এ সময় চিৎকারে তার বাবা পাশের রুম থেকে ছুটে এসে মেয়েকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে দুর্বৃত্তরা তাকেও কুপিয়ে জখম করে। পরে অন্য কোয়ার্টারের বাসিন্দারা বিষয়টি টের পেয়ে পুলিশে খবর দেন। তাদের আহত অবস্থায় উদ্ধার করে প্রথমে ঘোড়াঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রংপুরে পাঠানো হয়। ইউএনও ওয়াহিদা খানমকে রংপুর ডক্টরস ক্লিনিকে আইসিইউতে ও তার বাবাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য ওয়াহিদা খানমকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকায় পাঠানো হয়। ইউএনও ওয়াহিদাকে সরকারি বাসায় এভাকে আক্রমন করার ঘটনায় সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়। ঘটনার তদন্তে রংপুর বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেন। র্যাবসহ আইন শৃংখলা বাহিনী দুর্বত্তদের ধরতে অভিযান চালায়। তারা সফলও হয়।
ইউএনও’র বাসভবনে প্রবেশ করে হামলার ঘটনা প্রশাসনের বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। ইউএনও উপজেলা পরিষদের প্রধান সরকারি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা হুমকির মুখে এ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। এরই মধ্যে সরকার রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ৫৮ ইউএনও’র নিরাপত্তায় সশস্ত্র আনসার সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাদের কার্যালয় ও বাসভবন মিলিয়ে ১০জন আনসার সদস্য নিরাপত্তা দেবেন।
এদিকে আমাদের দিনাজপুর অফিস জানায়, হামলার ঘটনায় ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বড় ভাই শেখ ফরিদ উদ্দিন বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার রাতে অজ্ঞাত ৪ থেকে ৫ জনের বিরুদ্ধে ঘোড়াঘাট থানায় মামলা করেন। পরে র্যাব ও পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে গতকাল ভোর ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে হিলির কালিগঞ্জ এলাকায় বোনের বাড়ি থেকে উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলমকে (৪২) আটক করে। এছাড়াও উপজেলা যুবলীগের সদস্য আসাদুল ইসলামকে (৩৫) নিজ বাড়ি থেকে আটক করে। এরপর ঘোড়াঘাট উপজেলার শিংড়া ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও দক্ষিণদেবীপুর গ্রামের গোলাম মোস্তফা আদুর ছেলে মাসুদ রানা (৩৫), একই উপজেলার চক বামনদিয়া বিশ্বনাথপুর গ্রামের নবিরুল ইসলাম (৩৫), খোকার ছেলে সান্টু চন্দ্র দাস (২৮) এবং নৈশপ্রহরী নাহিদ হোসেন পলাশকে (৩৮) আটক করা হয়। আটক নবিরুল পেশায় রং মিস্ত্রি। ঘোড়াঘাট থানা ওসি আমিরুল ইসলাম জানান, মাসুদ ও নবিরুলকে গতকাল দুপুরে নিজ নিজ বাড়ি থেকে আটক করা হয়। এছাড়াও নৈশ্যপ্রহরী পলাশকে ডিবি পুলিশ আটক করে। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের রংপুরের র্যাব ১৩ এর কার্যালয়ে নেওয়া হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাত ৭টায় সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
এ সময় র্যাব-১৩ এর অধিনায়ক রেজা আহমেদ ফেরদৌস জানান, ইউওনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবার ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে। র্যাব শুরু থেকেই এ ঘটনায় ছায়া তদন্ত অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে আসাদুলকে গতকাল ভোরে হিলির কালীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী দিনভর অভিযান চালিয়ে নবিরুল ও সান্টুকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক স্বীকারোক্তিতে তারা চুরির উদ্দেশ্যে ইউওনও ওয়াহিদা খানমের বাসায় যান বলে জানিয়েছেন। এদের মধ্যে নবিরুল ইউওনও ওয়াহিদা খানমের মাথায় আঘাত করেন। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। তিনি বলেন, ঘটনার নেপথ্যে আরও কোনো কারণ আছে কি-না তা জানতে সময় লাগবে। অভিযুক্তদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘোড়াঘাট উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ত (বহিস্কৃত) জাহাঙ্গীরসহ আরও তিনজনকে আটক করা হলেও তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে সন্ত্রাসীদের বর্বর হামলার বিচার চেয়ে নিরাপদ বাংলাদেশ চাই দাবিতে মানববন্ধন করেছে দিনাজপুর করোনা দুর্যোগকালীন সম্মিলিত স্বেচ্ছাসেবক টিম। মানববন্ধন শেষে শহরের প্রধান সড়কে শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন শ্লোগান দিয়ে মিছিল করেন তারা। গতকাল সকাল ১১টায় দিনাজপুর প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে স্বাস্থবিধি মেনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন