কর্মক্ষেত্রে ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ইউএনও উপর মহলের (স্থানীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব) প্রভাব খাটাচ্ছেন এবং ৭ দশমিক ১০ শতাংশ ইউএনও জেলা প্রশাসন থেকে যথাসময়ে সহযোগিতা পান না। উপজেলা প্রশাসনের প্রধান হিসেবে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ ও প্রভাব, নিরাপত্তা ঝুঁকি, কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের নেতিবাচক ধারণা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহযোগিতা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার মতো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছেন নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা। ইউএনও প্রতিবদ্ধকতা দূর করতে আট দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটির ধানমন্ডির কার্যালয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় উপজেলা নারী নির্বাহী কর্মকর্তা কর্মকর্তা চ্যালেঞ্জ ও করণীয় শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশকালে এসব সুপারিশ করেছে টিআইবি। নারী ইউএনওরা স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে নারী ইউএনও আরও কার্যকর ভ‚মিকা রাখতে পারবে। যার মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের উন্নয়ন সাধিত হবে।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাহিদ শারমীন এবং তত্ত্বাবধায়ন করেন একই বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও প্রাক্তন সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার আবু সাঈদ মো. জুয়েল মিয়া।
গুণগত ও পরিমাণগত পদ্ধতি অনুসরণ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণাটি সম্পন্ন করা হয়েছে। জুন ২০২০ এর তথ্য অনুযায়ী, ৪৮৫টি উপজেলার মধ্যে ১৪৯টি উপজেলায় কর্মরত নারী ইউএনওকে জরিপের জন্য প্রশ্নপত্র ই-মেইলে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ৪৫ জন জরিপে অংশগ্রহণ করেন। গুণগত তথ্য সংগ্রহ করার জন্য মুখ্য তথ্যদাতা হিসেবে নারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা পর্যায়ে অন্যান্য সরকারি অফিসের কর্মকর্তা, প্রশাসন ক্যাডারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সরাসরি সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদে সাচিবিক সহায়তা প্রদানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী ইউএনওগণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে আসা অবৈধ আর্থিক সুবিধা অনুমোদন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ ইউএনও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণে অনিয়ম করতে চাপ প্রয়োগের কথা জানিয়েছেন। যার ফলে অতিরিক্ত ত্রাণ সামগ্রীর জন্য সুপারিশ করতে বাধ্য হতে হয় বলেছেন ২০ শতাংশ ইউএনও। এছাড়া, ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই না করতে বিভিন্ন মহল থেকে চাপ প্রয়োগ, ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ ভুয়া ব্যয়ের বিল অনুমোদন এবং ২৫ দশমিক ৭ শতাংশ নারী ইউএনও উপজেলা পরিষদের ক্রয় সংক্রান্ত কাজে অনিয়ম করতে বাধ্য করা হয়।
গবেষণায় বলা হয়, ২৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ নারী ইউএনওকে কার্য সম্পাদনে সহকর্মীদের পক্ষ থেকে এবং ৪০ দশমিক ৫ শতাংশকে উপজেলা চেয়ারম্যানের অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হয়। ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ ইউএনও দুর্নীতিবিরোধী কাজের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা, সমসংখ্যক ইউএনও বিভিন্ন মহল থেকে অনৈতিক কাজের জন্য চাপ, ৩১ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাব এবং ২৫ দশমিক ৭ শতাংশকে উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজে বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এছাড়া, উন্নয়ন কার্যাবলী তদারকিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দফতরের সাথে সমন্বয়হীনতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে অসহযোগিতার কথা বলেছেন ৩১ শতাংশ ইউএনও। এছাড়া, ৭ দশমিক ১০ শতাংশ ইউএনও জেলা প্রশাসন থেকে যথাসময়ে সহযোগিতা না পাওয়া ও ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ইউএনও উপর মহলের (স্থানীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিব) প্রভাব খাটানোর কথা বলেছেন।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, দুর্যোগ মোকাবিলায় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ৯৮ শতাংশ ইউএনও। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন ৯১ শতাংশ ইউএনও, এর মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রয়োজনীয় বাজেটের অভাব, ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অসহযোগিতা, ২২ দশমিক ৯ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণে দুর্নীতি, ২০ শতাংশ সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহের অসহযোগিতা এবং ৫ দশমিক ৭ শতাংশ ইউএনও মেডিকেলের সুরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয়ের দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কথা বলেছেন।
সুপারিশগুলো হচ্ছে, নারী ইউএনওদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব দূর করার জন্য উপজেলা পরিষদের জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদের অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নারীর প্রতি সংবেদনশীল আচরণের ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের এসিআরে জেন্ডার সংবেদশীলতাকে একটি সূচক হিসেবে রাখা যেতে পারে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সাচিবিক সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ইউএনও এবং চেয়ারম্যানদের নিয়ে ওরিয়েন্টেশনের আয়োজন করা। যার মূল লক্ষ্য হবে একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহযোগী এটা অনুধাবন করানো। দুর্নীতি প্রতিরোধে নারী ইউএনওর পদক্ষেপের জন্য জেলা পর্যায় তাকে সম্মানিত করা এবং পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। উন্নয়নমূলক কাজ সম্পাদন ও দুর্নীতি প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে কোনো নারী ইউএনও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর আক্রমণ ও ষড়যন্ত্রের শিকার হলে তাকে আইনগত সহায়তা দেওয়া ও নিরাপত্তা প্রদান করতে হবে। সংবাদমাধ্যমগুলো স্থানীয় পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যথা সাধ্য সঠিক সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে ইউএনওর কার্যক্রম সম্পাদনের ক্ষেত্রে সহযোগিতা প্রদান করবে। মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিবিদদের স্থানীয় উন্নয়নমূলক কাজে চাপ প্রয়োগ বন্ধ করার জন্য পরিপত্র জারি করতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারী ইউএনওর সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ওপর নারী ইউএনওদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী ইউএনওকে নিরাপত্তা ও সহযোগিতা প্রদান করার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তৎপর হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন