ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান আদিকাল থেকেই রয়েছে। সব সময় সব দেশের সরকার ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমাতে চেষ্টা করছে। আমাদের দেশের সরকারও বিগত ১২ বছর ধরে দারিদ্র্যের হার কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে আসছে। সম্পদশালীর সংখ্যা বৃদ্ধি হারের দিক দিয়ে গত দশ বছরে বিশ্বের অন্যতম বড় অর্থনীতিকে পেছনে ফেলে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২০১০ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ধনকুবের সংখ্যা বেড়েছে গড়ে ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ এদের সম্পদের পরিমাণ ৫০ লক্ষ ডলারের অধিক।
বহুজাতিক আর্থিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স এক দশকে বিশ্বের ধনী জনগোষ্ঠির সম্পদ পর্যালোচনা ও সামনের ১০ বছরের সম্পদ বণ্টন কেমন হবে, তার ওপর একটি গবেষণা চালিয়েছে। ‘আডিকেড অব ওয়েলথ’ শীর্ষক গবেষণায় নানা তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, গত এক দশকে ধনীর সংখ্যা বেড়েছে- এমন দেশগুলোর মধ্যে ছোট বড় অর্থনীতির মিশ্রণ রয়েছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি দেশ রয়েছে এশিয়ায়। প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে ৬টি এশিয়ার। এই তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম। উভয় দেশেই তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠি ও আঞ্চলিক উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রসার ঘটেছে।
আমাদের দেশে এক্ষেত্রে যে সমস্যাটি লক্ষনীয় তা হলো, ধনীর আয় যেভাবে বেড়েছে, দরিদ্রের আয় সেইভাবে বাড়েনি। এতে আয় ব্যবধান তৈরি হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের জরিপ আয় বৈষম্য বেড়েছে। দরিদ্রের আয় ধনীর মতো পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। বর্তমানে বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ দরিদ্র এবং প্রায় ২ কোটি মানুষ অতি দরিদ্র। তাই সরকারকে বিলিবণ্টন করতে হবে। ধনীরা ঠিকমত কর দিলে এবং সেই অর্থ জনগণের মধ্যে বিশেষ করে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় করলে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির পথ রচিত হবে। আয় বৈষম্য অধিক থাকলে কোনো দেশ ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের দেশ হতে পারে না।
ধনীদের সম্পদ বেড়ে চলেছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কৌশল ও পদক্ষেপের চিন্তা করতে হবে। যেমন:
১. সরকারকে কর আদায়ের বিশেষ জোর দিতে হবে। এই কাজে নিয়োজিত কর কর্মকর্তাদের ট্রেনিং ও স্বচ্ছতা বেশি প্রয়োজন। সৎ ও যোগ্য কর কর্মকর্তা নিয়োগ ছাড়া এই কাজ কোনক্রমেই সম্ভব হবে না।
২. আমাদের অর্থনীতি পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পরিচালিত। সুদভিত্তিক আমাদের আর্থিকখাত। অন্যদিকে সুদবিহীন ইসলামী শরীয়া মোতাবেক আমাদের দেশে ব্যাংক ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় মূল মেরুদন্ড হচ্ছে যাকাত। যাকাত হচ্ছে সম্পদশালীদের সম্পদে আল্লাহর নির্ধারিত সেই ফরজ অংশ, যা সম্পদ ও আত্মার পবিত্রতা অর্জন, সম্পদের ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং সর্বোপরি আল্লাহর রহমত লাভের আশায় নির্ধারিত খাতে ব্যয়বণ্টন করার জন্য দেওয়া হয়। পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারায় ১১০ আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তোমরা সালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। তোমরা উত্তম কাজের যা কিছু পূর্বে প্রেরণ করবে আল্লাহর নিকট তা পাবে। তোমরা যা কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তার স্রষ্টা।’
অনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমানোর জন্য পৃথিবীতে পরিক্ষীত সূত্র হচ্ছে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও তার সুষম বণ্টন। দেশে যাকাত ব্যবস্থা প্রবর্তন করলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান হ্রাস পাবে।
৩. প্রতি বছরের বাজেটে দেশে দারিদ্র্যে হার হ্রাস করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ ও অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়। এই পদক্ষেপ আরও দৃঢ় ও বড় আকারে নিতে হবে। কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন করে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। দরিদ্র জনগোষ্ঠিকে তুলে আনার জন্য বিনা সুদে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দীর্ঘ মেয়াদী ঋণ দিতে হবে। হতদরিদ্র, দ্বীপ অঞ্চল, সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে মানুষের জন্য বিশেষ কর্ম পরিকল্পনা নিতে হবে। বিল, চরাঞ্চল, পার্বত্য এলাকা মানুষের জন্য আলাদা অর্থ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
৪. সুশাসন ছাড়া অতি ধনী সৃষ্টির অপকৌশলসমূহ কোনক্রমেই বন্ধ করা যাবে না। সমাজে সর্বত্র সুশাসন কায়েম করতে হবে। আইনের শাসনের পরিবর্তে অন্যকোন উপায়ে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমানো যাবে না। আইনের শাসনের অভাবে আজ আমাদের ব্যাংকিং খাত দৈন্যদশায় পড়েছে। করোনা পরবর্তী ব্যাংকিং খাত বেশি ঝুঁকিতে পড়বে। এই অবস্থায় দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য ব্যাংকিং খাত তেমন বড় ভূমিকা রাখতে পারতো, তা হয়তো পারবে না।
৫. মূল্যবোধ, মানবতা, মানুষের প্রতি মমতা, ভালবাসা ইত্যাদি আমরা মৌলিক শিক্ষা থেকে আহরণ করি। আমাদের মৌলিক শিক্ষায় গলদ রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু মুখস্ত করে পরীক্ষা পাশের চেষ্টা, সার্টিফিকেট অর্জন, তা দেখিয়ে মামার জোরে একটা চাকরি অর্জন- আমাদের অনেক যুবকদের ইচ্ছা। এটা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য নয়। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মূল্যবোধ শিক্ষা, মানবতা শিক্ষা, মমতা ভালবাসা শিক্ষা, মানব কল্যাণ করার মতো চরিত্রবান মানুষ তৈরি। উপযুক্ত মানুষ হলে কর ফাঁকি না দিয়ে তারা দেশ সেবায় মন দেবে। এত দ্রুত ধনী হওয়ার পথ বন্ধ হবে।
৬. আমাদের নেতাদের চরিত্রের পরিবর্তন আনতে হবে। নেতা সৎ, কর্মঠ, নিষ্ঠাবান ও দেশপ্রেমিক হলে তার কর্মীরাও অনুরূপ হবে। নেতার সততা না থাকলে কর্মীদেরও কোনো সততা তৈরি হবে না। আর সৎ নেতা না হলে কর্মীরাও অসৎ পথে হাঁটবে। তখন দ্রুত ধনী হওয়ার সকল অপকৌশল দেশের নেতা যেমন অবলম্বন করবেন, তেমনি অন্য সকল কর্মীও তাই করবেন। একারণেই বিগত ১০ বছরে কয়েকগুণ বেশি অতি ধনী ব্যক্তির জন্ম হয়েছে।
৭. চরিত্রের পরিবর্তন বা সৎ চরিত্রবান মানুষ তৈরির জন্য প্রয়োজন ভালো কারখানা বা কারিগর। তা হচ্ছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে নতুন করে সাজাতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মূল্যবোধের শিক্ষা ছাড়া, স্ব-স্ব ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া কোনক্রমে ভালো মানুষ, সৎ চরিত্রবান মানুষ তৈরি করা যাবে না। সৎ মানুষ হলে, সৎ নেতৃত্ব দেশে আসবে। দুর্নীতি, অন্যায়, অবিচার, জুলুম, নির্যাতনও কমে যাবে।
৮. আমাদের দেশে ব্যক্তি আয়করের পরিমাণ বেশি। ব্যক্তি পর্যায় ৩৫ শতাংশ এবং কর্পোরেট খাতে ৪৭ শতাংশ আয়কর দিতে হয়। পৃথিবীর উন্নত দেশে ৪৫ শতাংশের বেশি ব্যক্তি আয়কর নাই। আবার ঐ সকল দেশের করের বিনিময়ে মানুষ সেবা পায়। বেকার সময়ে সরকার করদাতাদের খরচের জন্য ভাতাও দেয়।
৯) ১০ বছরে ধনীর সংখ্যা সবচেয়ে কম আয়ারল্যান্ডে। হার হচ্ছে ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অথচ আমাদের মতো একটি অনুন্নত দেশে ধনী বৃদ্ধির হার ১৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক ধনী দ্রুত সৃষ্টি বাংলাদেশে একটি অবাক করার মতো ঘটনা। অর্থ পাচার ও লুণ্ঠন ছাড়া এ রকম দ্রুত ধনী হওয়া সম্ভব নয়। লুণ্ঠন বন্ধ করতে হবে।
১০) মানুষ বেশি ধনী হোক, এটি আমাদের সকলের একান্ত কাম্য। কিন্তু তা হতে হবে সৎভাবে। সততার সঙ্গে অর্থ উপার্জন সম্পূর্ণরূপে বৈধ বিষয়। এটি একজন নাগরিকের বৈধ অধিকার। কিন্তু অবৈধ, অন্যায়ভাবে অর্থ উপার্জন অপরাধ। এই ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণে দেশে অতি ধনীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।
পরিবেশের সুযোগ নিয়ে কিছু সংখ্যক ধনী ব্যক্তি ধনী থেকে আরও বেশি ধনীতে পরিণত হচ্ছেন, এটা ঠেকাতে। সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে মজুত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলকও করতে হবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি ও প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন