আরবী তাওবাহ শব্দের অর্থ হচ্ছে দূর হতে নিকটে ফিরে আসা, প্রত্যাবর্তন করা। তাওবাহ এর দু’টি সীমা আছে। একটি তাওবাহর প্রারম্ভ এবং দ্বিতীয়টি তাওবাহর শেষ প্রান্ত। যখন আল্লাহর পথের পথিকের অন্তরে আল্লাহপাকের মারেফাতের নূর বিকশিত হয়ে অন্তর আলোকিত হয় এবং গোনাহের অপকারিতা মর্মে মর্মে অনুভব করতে থাকে, তখন পথিক তাওবাহর প্রাথমিক সীমায় উপস্থিত হয়।
তারপর ভীত লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে যাবতীয় পাপকর্ম পূর্ণরূপে ত্যাগ করে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা করে ভবিষ্যতে গোনাহ হতে পবিত্র থাকার জন্য সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এবং তৎসহ পূর্বকৃত গোনাহের প্রতিকারে ব্রতী হয়, এটাই হলো তাওবাহর শেষ সীমা। বস্তুত পাপ কাজ হতে তাওবাহ করে পুনরায় কখনো সেই পাপের নিকটবর্তী না হওয়াকেই প্রকৃত তাওবাহ বলে।
এই পৃথিবীতে বসবাসকারী লোকদের মধ্যে যারা পাপ কাজ করে না এমন লোকের সংখ্যা কত কম তার হিসাব দেয়া কঠিন। বলতে গেলে প্রত্যেক লোকই কম-বেশি গোনাহগার। তবে গোনাহগারদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই উত্তম, যে তাওবাহ করে, অনুতপ্ত হয়।
চলমান মানব জীবনের গতিময়তার ওপর লক্ষ রেখে ইমাম গাজ্জালী (রহ.) বলেছেন : তাওবাহ করার পর পুনরায় যদি তাওবাহকারী সে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তাহলে অতিদ্রæত পুনরায় তাওবাহ করবে এবং মনে মনে বলবেÑ আহা! পুনরায় পাপে লিপ্ত হওয়ার আগেই যদি পূর্বকৃত তাওবাহর অবস্থায়ই মৃত্যু হতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। এভাবে তিনবার কিংবা চারবারও যদি হয়, তবুও তাওবাহ করা উচিত।
মোটকথা, যখনই গোনাহে লিপ্ত হবে, তখনই তাওবাহ করবে। পুনরায় গোনাহে লিপ্ত হওয়ার সাথে সাথেই তাওবাহ করতে থাকবে। মনে রাখবে গোনাহ এবং তাওবাহ এ দুটোর মধ্যে যেন দূরত্ব সৃষ্টি না হয় এবং তাওবাহর ব্যাপারে যেন শৈথিল্য দেখা না দেয়। শয়তান সব সময়ই তাওবাহ করতে বিলম্ব সৃষ্টির চেষ্টা করে। কারণ, তাওবাহ নেক কাজের পরিসর বৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রদান করে।
হযরত আবু বকর কাত্তানী (রহ.) বলেছেন : ছয়টি বিষয়ের সমষ্টির নাম তাওবাহ। যথাÑ (১) পূর্বে যে পাপ কাজ করা হয়েছে, সে সবের জন্য মনে মনে অনুতাপ করা। (২) যাতে ভবিষ্যতে আবার পাপে লিপ্ত না হয়, তার প্রতি সজাগ থাকা। (৩) আল্লাহ পাকের যে সকল হক নষ্ট করা হয়েছে, তা সম্পাদন করা। (৪) মানুষের যে হক নষ্ট করা হয়েছে, তা আদায় করা। (৫) হারাম বস্তু খেয়ে শরীরে সে গোশ্ত উৎপন্ন হয়েছে, তা ক্ষয় করা এবং (৬) যে সকল পাপের স্বাদ ও মিষ্টতা আস্বাদন করা হয়েছে, তদনুরূপ শরীর ও মনকে সাধনার তিক্ততা ভোগ করতে দেয়া। বস্তুত আল্লাহর পথের পথিকদের একান্ত অবলম্বনই হচ্ছে তাওবাহ করা।
হযরত যুন্নুন মিসরী (রহ.) বলেছেন : মানব দেহের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়ের জন্যই তাওবাহ আছে। যেমনÑ (ক) হারাম চিন্তা পরিত্যাগের সংকল্প করা হচ্ছে মনের তাওবাহ। (খ) হারাম বস্তু দর্শন হতে বিরত থাকা হলো চক্ষুর তাওবাহ। (গ) অবৈধ কথা শ্রবণ হতে ক্ষান্ত থাকা হচ্ছে কর্মের তাওবাহ। (ঘ) হারাম বস্তু গ্রহণে বিরত থাকা হচ্ছে হস্তের তাওবাহ। (ঙ) নিষিদ্ধ পথে গমন হতে বিরত থাকা হচ্ছে পায়ের তাওবাহ। (চ) হারাম বস্তু না খাওয়ার নাম হচ্ছে উদরের তাওবাহ এবং (ছ) ব্যভিচার ও লজ্জাহীনতার কাজ হতে বিরত থাকা হচ্ছে গুপ্ত অঙ্গের তাওবাহ।
যখন কেউ গোনাহ করে, তখনই ফিরিশতা সেই গোনাহ লিপিবদ্ধ করে না। বরং তিন ঘণ্টা পর্যন্ত গোনাহগারের তাওবাহর অপেক্ষায় থাকে। যদি এর মাঝে তাওবাহ করে নেয়, তবে সেই গোনাহ আর লেখা হয় না। আর যখন কোনো বান্দাহ গোনাহ স্বীকার করে, তখন আল্লাহ পাক তার তাওবাহ কবুল করেন। প্রকৃতপক্ষে কৃতপাপের জন্য শরমিন্দা হয়ে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাওয়ার নামই তাওবাহ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবাহ করো বা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। কেননা, তাওবাহকারী আল্লাহর প্রিয় পাত্র।
আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তাওবাহকারীদের ভালোবাসেন।’ তাছাড়া তাওবাহকারীদের খোশখবরী প্রদান করে আল্লাহপাক ঘোষণা করেছেন : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সকলেই আল্লাহর দরবারে তাওবাহ করো। নিশ্চয়ই তোমরা সফলতা লাভ করবে।’ আল্লাহপাক তাওবাহর মাধ্যমে পরিপূর্ণ কামিয়াবী ও সফলতা অর্জন করার তাওফিক এনায়েত করুন, এটাই আজকের একান্ত প্রত্যাশা। আমীন !
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন